Thursday, May 18, 2023

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী/ Horprosad Shastri

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (৬ ডিসেম্বর,১৮৫৩–১৭ নভেম্বর,১৯৩১) ছিলেন বিখ্যাত বাঙালি ভারততত্ত্ববিদ,সংস্কৃত বিশারদ,সংরক্ষণবিদ ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা। তাঁর আসল নাম ছিল হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের আবিষ্কর্তা। তিনি সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিতম্ বা রামচরিতমানস পুঁথির সংগ্রাহক। জন্ম হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য' ৬ ডিসেম্বর ১৮৫৩ কুমিরা,খুলনা,বাংলা প্রদেশ,ব্রিটিশ ভারত মৃত্যু ১৭ নভেম্বর,১৯৩১) ধরন ঔপন্যাসিক বিষয় পুঁথি সংগ্রাহক উল্লেখযোগ্য রচনাবলি বাল্মীকির জয়,মেঘদূত ব্যাখ্যা,বেণের মেয়ে,কাঞ্চনমালা, সচিত্র রামায়ণ,প্রাচীন বাংলার গৌরব,বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁদের আদি নিবাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটিতে। তাঁর পারিবারিক পদবী ছিল ভট্টাচার্য। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর হরপ্রসাদ কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতায় তিনি তাঁর বড়দা নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বন্ধু তথা বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে থাকতেন।১৮৭১ সালে হরপ্রসাদ প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৩ সালে পাস করেন ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষা।১৮৭৬ সালে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৭৭ সালে সংস্কৃতে সাম্মানিক হন। পরে এম.এ. পরীক্ষায় পাস করে তিনি 'শাস্ত্রী' উপাধি লাভ করেন। উক্ত পরীক্ষায় হরপ্রসাদই ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র। কর্মজীবন ১৮৭৮ সালে তিনি হেয়ার স্কুলে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন।১৮৮৩ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময়ই বাংলা সরকার তাঁকে সহকারী অনুবাদক নিযুক্ত করে। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃত বিভাগীয় প্রধান হন।এরপর ১৯০০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। ১৯০৮ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি সরকারের তথ্যকেন্দ্রে যোগ দেন। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান।অধ্যাপনা ও সরকারি কাজের পাশাপাশি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দু বছর এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, বারো বছর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি এবং লন্ডনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রথম গবেষণাপত্রটি ভারত মহিলা নামে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সময় তিনি ছিলেন ছাত্র। পরে হরপ্রসাদ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখকে পরিণত হন এবং নানা বিষয় নিয়ে লেখালিখি শুরু করেন। হরপ্রসাদকে ভারততত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী করে তোলেন বিশিষ্ট ভারততত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তিনি রাজেন্দ্রলালের দ্য সংস্কৃত বুদ্ধিস্ট লিটারেচার অফ নেপাল গ্রন্থে সঙ্কলিত বৌদ্ধ পুরাণগুলির অনুবাদ শুরু করেন। এশিয়াটিক সোসাইটিতে তিনি রাজেন্দ্রলালের সহকারী ছিলেন। রাজেন্দ্রলালের মৃত্যুর পর সোসাইটিতে সংস্কৃত পুঁথি অন্বেষণ বিভাগের পরিচালক হন।অল্প কয়েকজন সহকারী নিয়ে হরপ্রসাদ এশিয়াটিক সোসাইটির দশ হাজার পুঁথির ক্যাটালগ প্রস্তুত করেন।এই ক্যাটালগের যে দীর্ঘ মুখবন্ধটি তিনি রচনা করেছিলেন, তা সংস্কৃত সাহিত্যের একটি মূল্যবান ইতিহাস। সংস্কৃত পুঁথি নিয়ে চর্চা করতে করতেই হরপ্রসাদ বাংলা পুঁথির বিষয়েও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পুঁথির সন্ধানে তিনি অনেকবার নেপাল গিয়েছিলেন। সেখানেই ১৯০৭ সালে তিনি আবিষ্কার করেন চর্যাগীতি বা চর্যাপদের পুঁথি।এই পুঁথিগুলি নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন এগুলিই বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন। ব্যাক্তির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কথা কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥ ধ্রু॥ দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ। লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥ ধ্রু॥ সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই। সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই॥ ধ্রু॥ এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস। সুনুপাখ ভিতি লেহু রে পাস॥ ধ্রু॥ ভণই লুই আম্‌হে ঝানে দিঠা। ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা॥ ধ্রু॥ অনুবাদ: শরীরের গাছে পাঁচখানি ডাল– চঞ্চল মনে ঢুকে পড়ে কাল। দৃঢ় ক’রে মন মহাসুখ পাও, কী–উপায়ে পাবে গুরুকে শুধাও। যে সবসময় তপস্যা করে দুঃখে ও সুখে সেও তো মরে। ফেলে দাও পারিপাট্যের ভার, পাখা ভর করো শূন্যতার– লুই বলে, ক’রে অনেক ধ্যান দেখেছি, লভেছি দিব্যজ্ঞান। অনুবাদ না করে দিলে পড়া যেত না তাই না প্রিয় পাঠক? ভাবছেন এটা আবার কোন ভাষা? যদি বলি বাংলা? বলবেন এই পাগলটা কি না বলে? এই কাঠখট্টা ভাষা কি করে আমার প্রিয় বাংলা হয়। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন এটা বাংলা ভাষাই। তবে এই আমলের বাংলা ভাষা নয়। আজ থেকে কমপক্ষে এক হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। এটা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম, এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদের অংশ। । বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগের এই একটাই নিদর্শন পাওয়া গেছে; তবে তার মানে এই নয়, সে যুগে বাংলায় আর কিছু লেখা হয়নি। হয়তো লেখা হয়েছিল, কিন্তু সংরক্ষিত হয়নি। একবারও কি জানতে ইচ্ছা করে না কে ইতিহাসের ধুলোমাখা অতীত থেকে আবার আবিষ্কার করেছিলেন এই চর্যাপদ? তাঁর নাম মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। আজ তারই গল্প শোনাবো। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৮৫৩ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে চব্বিশপরগনার নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম পিতার নাম রামকমল ন্যায়রত্ন। ১৮৬৬ সালে গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং সংস্কৃত কলেজে প্রবেশ করেন। ১৮৭১ সালে নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৭৩ সালে এফ.এ পাশ করেন। ১৮৭৬ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। বি.এ পরীক্ষায় তিনি ৮ম স্থান অধিকার করেছিলেন। ‘ভারত মহিলা’ প্রবন্ধ রচনা করে হোলকার পুরস্কার পান। ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হলে বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়। কলকাতায় তিনি তাঁর বড়দা নন্দকুমার ন্যায়চঞ্চুর বন্ধু তথা বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে থাকতেন। ১৮৭৭ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে এম.এ পরীক্ষায় একমাত্র তিনিই প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ‘শাস্ত্রী’ উপাধি পান। ১৮৭৮ সালের মার্চ মাসে বিবাহ করেন। ১৮৭৮ সালে কর্মজীবনের সুচনায় কলিকাতা হেয়ার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। ক্রমে লক্ষ্ণো ক্যানিং কলেজ, কলিকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। পুরাতন পুঁথি সংগ্রহের মাধ্যমে চর্যাপদ গবেষণা করে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনত্বকে প্রমাণিত করেন। ‘গোপাল তাপনি’ উপনিষদের ইংরেজী অনুবাদে তিনি রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সহযোগী ছিলেন। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত লেখা থেকে পাঠোদ্ধার এবং পুঁথি আবিষ্কার ও টীকা রচনা করে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক সংস্কৃত পুঁথিসংগ্রহের কাজে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। এই কাজে তিনি নেপাল. তিব্বত ভ্রমণ করেন। রচনাসমগ্র ১৯১৬ সালে চর্যাপদের পুঁথি নিয়ে রচিত তাঁর গবেষণাপত্র হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা নামে প্রকাশিত হয়।হরপ্রসাদ অনেক প্রাচীন গ্রন্থ সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বহু গবেষণাপত্রও রচনা করেন। তিনি ছিলেন এক খ্যাতনামা হিস্টোরিওগ্রাফার। স্বীয় কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছিলেন বহু পুরস্কার ও সম্মান।তাঁর বিখ্যাত বইগুলি হল বাল্মীকির জয়, মেঘদূত ব্যাখ্যা, বেণের মেয়ে (উপন্যাস), কাঞ্চনমালা (উপন্যাস), সচিত্র রামায়ণ, প্রাচীন বাংলার গৌরব ও বৌদ্ধধর্ম।তাঁর উল্লেখযোগ্য ইংরেজি রচনাগুলি হল মগধান লিটারেচার, সংস্কৃত কালচার ইন মডার্ন ইন্ডিয়া ও ডিসকভারি অফ লিভিং বুদ্ধিজম ইন বেঙ্গল। “ বাঙালিয়ানা, বাঙালিত্ব, আমি বাঙালি এই বোধ।আমার বাঙালি বলিয়া যে একটা সত্তা আছে,এই জ্ঞান।বেশি সংস্কৃত পড়িলে লোকে ব্রাহ্মণ হইতে চায়,ঋষি হইতে চায়।সেটা খাঁটি বাংলার জিনিস নয়; তাহার সঞ্চার পশ্চিম হইতে।বেশি ইংরাজি পড়িলে কী হয় তাহা আর বলিয়া দিতে হইবে না।... বাঙালিয়ানার অর্থ এই যে, বাংলার যা ভালো তাহা ভালো বলিয়া জানা, আর যাহা মন্দ তাহা মন্দ বলিয়া জানা। ভালো লওয়া ও মন্দ না লওয়া তোমার নিজের কাজ। কিন্তু জানাটা প্রত্যেক বাঙালির দরকারি কাজ। জানিতে হইলে বুদ্ধিপূর্বক বাংলা দেশটা কী দেখিতে হইবে, বাংলায় কে থাকে দেখিতে হইবে, বাংলার আচার ব্যবহার, রীতি-নীতি, সমাজ-সংসার, উৎসব-আনন্দ, দুঃখ-শোক, কুস্তি লাঠিখেলা টোল পাঠশালা দেখিতে হইবে। ইহার গান গীতি পয়ার পাঁচালী, নাচ খেমটা, কীর্তন ঢপ যাত্রা কবি সব দেখিতে হইবে। মন প্রাণ দিয়া দেখিতে হইবে। আবার এখনকার কালে যাহা যাহা বদলাইতেছে, তাহাও দেখিতে হইবে। খবরের কাগজ, মাসিক পত্র, কনসার্ট, থিয়েটার, ইস্কুল, কলেজ, আপিস, আদালত সবই দেখিতে হইবে। বাংলার এবং বাঙালি জাতির সমস্ত জীবনটা ভালো করিয়া দেখিতে হইবে, তবেই তুমি বাঙালি হইবে। -হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, ২য় খণ্ড

Sunday, July 4, 2021

হাদীস: 07

‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

মাসজিদে জুমু’আহর সালাতে তিন ধরনের লোক এসে থাকে। এক শ্রেণীর লোক জুমু’আহয় উপস্থিত হয়ে অনর্থক কথা ও কাজে লিপ্ত হয়। সে তার ‘আমল অনুসারেই তার অংশ পাবে। আরেক শ্রেণীর লোক জুমু’আহুয় এসে দু‘আ করে, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট প্রার্থণা করে। তিনি ইচ্ছে করলে তাদের দু‘আ কবুল করতে পারেন অথবা নাও করতে পারেন। আরেক শ্রেণীর লোক জুমু’আহয় উপস্থিত হয়ে চুপচাপ থাকে, কোন মুসলিমের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে যায় না এবং কাউকে কষ্ট দেয় না। এই কাজ গুলো ঐ ব্যাক্তির জন্য ঐ জুমু’আহ হতে পরবর্তী জুমু’আহ পর্যন্ত এবং অতিরিক্ত আরো তিনদিন পর্যন্ত গুনাএর কাফফারা হবে কেননা মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যাক্তি একটি নেকীর কাজ করবে বিনিময়ে তাকে তার দশ গুন সওয়াব দেয়া হবে” (সূরাহ আল-আনআমঃ ১৬০)।

রেফারেন্সঃ
সুনানে আবু দাউদ ১১১৩
http://ihadis.com/books/abi-dawud/hadis/1113

Friday, July 2, 2021

ঘুমাতে যাওয়ার আগের দুআ ও আমল

দুআ
------------------

بِاسْمِكَ اللّٰهُمَّ أَمُوْتُ وَأَحْيَا 

অথবা,

اللَّهُمَّ بِاسْـمِكَ أَمُوتُ وَأَحْيَا

"হে আল্লাহ ! আপনার নাম নিয়েই আমি মরছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হবো।"


বুখারী, (ফাতহুল বারীসহ) ১১/১১৩, নং ৬৩২৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে অন্যান্য আমলসমূহ
-------------------------------------------

ঘুমাতে যাওয়ার আগে রাসূল (সা.) বেশ কিছু আমল করতেন। এই সুন্নাহগুলো পালন করার মাধ্যমে আমরা আমাদের ঘুমকেও ইবাদতের সমতুল্য করে তুলতে পারি। ঘুমানোর আগের সুন্নাহগুলো প্রথমে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরে পরে বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

ব্যবহার্য থালা-বাসন, হাড়ি-পাতিল ঢেকে রাখা ও বাতি নিভিয়ে দেয়া
১। অযু করা
২। ঘুমের পূর্বে পড়ার জন্য বিশেষ কয়েকটি দুয়া আছে সেগুলো পড়া (যেমনঃ আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া)
৩।  সূরা কাফিরুন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস পড়া
৪। ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া
৫। আয়াতুল কুরসী পড়া
৬। সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া
৭। সূরা সাজদাহ ও সূরা মুলক পড়া
৮। ডান কাত হয়ে ঘুমানো

উপরের পয়েন্টগুলোর বিস্তারিত ও রেফারেন্স নিচে পর্যায়ক্রমে তুলে ধরা হলোঃ

ব্যবহার্য থালা-বাসন, হাড়ি-পাতিল ঢেকে রাখা ও বাতি নিভিয়ে দেয়া
---------------------------------
জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ 

"যখন রাত্রের আঁধার নেমে আসে, অথবা বলেছেনঃ সন্ধ্যা হয়, তখন তোমাদের শিশুদেরকে (বাইরে যাওয়া থেকে) আবদ্ধ রাখো। কেননা সে সময় শয়তান ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতের কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে তাদেরকে ছেড়ে দাও এবং বিসমিল্লাহ বলে ঘরের দরজাসমূহ বন্ধ করো। কারণ শয়তান বদ্ধদ্বার খুলতে পারে না। আর বিসমিল্লাহ পড়ে তোমাদের মশকগুলোর মুখ বন্ধ করো এবং বিসমিল্লাহ বলে তোমাদের পাত্রগুলোও ঢেকে রাখো। (ঢাকার কিছু না পেলে) কোন কিছু আড়াআড়িভাবে হলেও পাত্রের উপর রেখে দাও। (আর ঘুমানোর সময়) বাতিগুলো নিভিয়ে দাও।" (বুখারী ও মুসলিম)

১। অযু করা
-----------------------------------------------
হজরত বারা ইবনে আযিব হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছেন, 

‘যখন তুমি তোমার শয্যা গ্রহণের ইচ্ছা করবে, তখন সালাতের ন্যায় অজু করে ডান কাত হয়ে শয়ন করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

যে ব্যক্তি পবিত্রাবস্থায় (অজু অবস্থায় ) ঘুমায় তার সাথে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে। অতঃপর সে ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহর সমীপে ফেরেশতাটি প্রার্থনায় বলে থাকে, হে আল্লাহ! তোমার অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দাও, কেননা সে পবিত্রাবস্থায় ঘুমিয়েছিল।’ (আল ইহসান ফি তাকরিব, সহীহ ইবনে হিব্বান)

২। ঘুমের পূর্বে পড়ার জন্য বিশেষ কয়েকটি দুয়া আছে সেগুলো পড়া
------------------------------------------------------------
ক.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন তখন তাঁর ডান হাত তাঁর গালের নীচে রাখতেন, তারপর এ দো‘আটি বলতেন:

اللّٰهُمَّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ 

"হে আল্লাহ! আমাকে আপনার আযাব থেকে রক্ষা করুন, যেদিন আপনি আপনার বান্দাদেরকে পুনর্জীবিত করবেন।"
আবূ দাউদ, শব্দ তাঁরই, ৪/৩১১, নং ৫০৪৫; তিরমিযী, নং ৩৩৯৮; আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী, ৩/১৪৩; সহীহ আবী দাঊদ, ৩/২৪০

খ.
بِاسْمِكَ اللّٰهُمَّ أَمُوْتُ وَأَحْيَا 

"হে আল্লাহ ! আপনার নাম নিয়েই আমি মরছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হবো।"

বুখারী, (ফাতহুল বারীসহ) ১১/১১৩, নং ৬৩২৪; মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১

গ.
اللّٰهُمَّ إِنَّكَ خَلَقْتَ نَفْسِيْ وَأَنْتَ تَوَفَّاهَا، لَكَ مَمَاتُهَا وَمَحْيَاهَا، إِنْ أَحْيَيْتَهَا فَاحْفَظْهَا، وَإِنْ أَمَتَّهَا فَاغْفِرْ لَهَا، اللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ العَافِيَةَ 

"হে আল্লাহ! নিশ্চয় আপনি আমার আত্মাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনি তার মৃত্যু ঘটাবেন। তার মৃত্যু ও তার জীবন আপনার মালিকানায়। যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখেন তাহলে আপনি তার হেফাযত করুন, আর যদি তার মৃত্যু ঘটান তবে তাকে মাফ করে দিন। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে নিরাপত্তা চাই।"
মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১২; আহমাদ, তাঁর শব্দে ২/৭৯, নং ৫৫০২।

গ.
 رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبَّ الأَرْضِ، وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ، فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى، وَمُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيْلِ، وَالْفُرْقَانِ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ، 

"হে আল্লাহ! হে সপ্ত আকাশের রব্ব, যমিনের রব্ব, মহান ‘আরশের রব্ব, আমাদের রব্ব ও প্রত্যেক বস্তুর রব্ব, হে শস্য-বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী, হে তাওরাত, ইনজীল ও কুরআন নাযিলকারী, আমি প্রত্যেক এমন বস্তুর অনিষ্ট থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, যার (মাথার) অগ্রভাগ আপনি ধরে রেখেছেন (নিয়ন্ত্রণ করছেন)।"

اللّٰهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُوْنَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ 

"হে আল্লাহ! আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছুই ছিল না; আপনি সর্বশেষ, আপনার পরে কোনো কিছু থাকবে না; আপনি সব কিছুর উপরে, আপনার উপরে কিছুই নেই; আপনি সর্বনিকটে, আপনার চেয়ে নিকটবর্তী কিছু নেই, আপনি আমাদের সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং আমাদেরকে অভাবগ্রস্ততা থেকে অভাবমুক্ত করুন।"

মুসলিম ৪/২০৮৪, নং ২৭১৩

ঘ.
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا، وَكَفَانَا، وَآوَانَا، فَكَمْ مِمَّنْ لاَ كَافِيَ لَهُ وَلاَ مُؤْوِيَ 

"সকল প্রশংসা আল্লাহ্‌র জন্য, যিনি আমাদেরকে আহার করিয়েছেন, পান করিয়েছেন, আমাদের প্রয়োজন পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। কেননা, এমন বহু লোক আছে যাদের প্রয়োজনপূর্ণকারী কেউ নেই এবং যাদের আশ্রয়দানকারীও কেউ নেই।"
মুসলিম ৪/২০৮৫, নং ২৭১৫

ঙ.
اللّٰهُمَّ عَالِمَ الغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ، رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَّمَلِيْكَهُ، أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِي، وَمِنْ شَرِّ الشَّيْطانِ وَشِرْكِهِ، وَأَنْ أَقْتَرِفَ عَلَى نَفْسِيْ سُوءًا، أَوْ أَجُرَّهُ إِلَى مُسْلِمٍ 

"হে আল্লাহ! হে গায়েব ও উপস্থিতের জ্ঞানী, হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা, হে সব কিছুর রব্ব ও মালিক! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি ছাড়া আর কোনো হক্ব ইলাহ নেই। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আমার আত্মার অনিষ্ট থেকে, শয়তানের অনিষ্টতা থেকে ও তার শির্ক বা তার ফাঁদ থেকে, আমার নিজের উপর কোনো অনিষ্ট করা, অথবা কোনো মুসলিমের দিকে তা টেনে নেওয়া থেকে।"
আবূ দাউদ, ৪/৩১৭, নং ৫০৬৭; তিরমিযী, নং ৩৬২৯; আরও দেখুন, সহীহুত তিরমিযী, ৩/১৪২।

চ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘তোমাদের কোনো ব্যক্তি তার বিছানা ত্যাগ করলো, আবার ঘুমাতে ফিরে এলো সে যেন তার চাদর বা লুঙ্গির আঁচল দিয়ে তিনবার বিছানাটি ঝেড়ে নেয়। আর যেন সে বিসমিল্লাহ পড়ে, (আল্লাহর নাম নেয়); কেননা সে জানে না যে, তার চলে যাবার পর এতে কী পতিত হয়েছে। 

তারপর সে যখন শোয়, তখন যেন এ দো‘আটি বলে,

بِاسْمِكَ رَبِّيْ وَضَعْتُ جَنْبِي، وَبِكَ أَرْفَعُهُ، فَإِنْ أَمْسَكْتَ نَفْسِيْ فارْحَمْهَا، وَإِنْ أَرْسَلْتَهَا فَاحْفَظْهَا، بِمَا تَحْفَظُ بِهِ عِبَادَكَ الصَّالِحِيْنَ 

"আমার রব! আপনার নামে আমি আমার পার্শ্বদেশ রেখেছি (শুয়েছি) এবং আপনারই নাম নিয়ে আমি তা উঠাবো। যদি আপনি (ঘুমন্ত অবস্থায়) আমার প্রাণ আটকে রাখেন, তবে আপনি তাকে দয়া করুন। আর যদি আপনি তা ফেরত পাঠিয়ে দেন, তাহলে আপনি তার হেফাযত করুন যেভাবে আপনি আপনার সৎকর্মশীল বান্দাগণকে হেফাযত করে থাকেন।"

বুখারী, ফাতহুল বারীসহ ১১/১২৬, নং ৬৩২০; মুসলিম ৪/২০৮৪, নং ২৭১৪। 

৩। সূরা কাফিরুন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস পড়া
------------------------------------------------------------------------------

ফরওয়াহ ইবনু নাওফাল (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এসে বললেন, 

"হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমাকে কিছু শিখিয়ে দিন, যা আমি বিছানাগত হওয়াকালে বলতে পারি।" 

তিনি বললেনঃ তুমি "কুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফিরুন" সূরাটি তিলাওয়াত কর। কারণ তা শিরক হতে মুক্তির ঘোষণা। 

সহীহঃ তা’লীকুর রাগীব (হাঃ ১/২০৯)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগণকে বললেন, “তোমরা কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়তে পারনা”? প্রস্তাবটি সাহাবাদের জন্য কঠিন মনে হল। তাই তাঁরা বলে উঠলেন, “হে আল্লাহর রসুল! এই কাজ আমাদের মধ্যে কে করতে পারবে?” (অর্থাৎ কেউ পারবে না।) তিনি বললেন, “ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস স্বামাদ” (সুরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান”।. (অর্থাৎ এই সুরা পড়লে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়ার সমান নেকী পাওয়া যাবে)। 

সহীহুল বুখারী ৫০১৫, নাসায়ী ৯৯৫, আবু দাউদ ১৪৬১, আহমাদ ১০৬৬৯

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রাত্রে শয্যা গ্রহনের সময় তালুদ্বয় একত্রিত করে তাতে সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। অতঃপর হাতদ্বয় দ্বারা শরীরের যতদূর পর্যন্ত বুলানো সম্ভব হতো, ততদূর পর্যন্ত বুলিয়ে নিতেন। স্বীয় মাথা, চেহারা এবং শরীরের সামনের দিক থেকে আরম্ভ করতেন। এইভাবে তিনি তিনবার করতেন।’’ (বুখারী ৫০১৭)

এটা জাদু-টোনা ও দুষ্ট জ্বীন-শয়তান থেকে ব্যক্তিকে নিরাপদ রাখবে ইনশাআল্লাহ।

৪। ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়া
---------------------------------------------------------------

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, ফাতিমা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে একটি চাকর চাইলে, তিনি বললেন, “আমি কি তোমাদের দু’জনকে এমন জিনিস বলে দেবো না, যা তোমাদের চাকরের চেয়ে উত্তম? তোমরা যখন বিছানায় শুতে যাবে, তখন ৩৪ বার আল্লাহু আকবর, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ এবং ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ পড়বে। এটা তোমাদের চাকরের চেয়েও উত্তম।” (বুখারী ৬৩১৮, মুসলিম ৬৯১৫)

৫। আয়াতুল কুরসী পড়া
----------------------------------
নবী (সা) বলেনঃ “যখন বিছানায় ঘুমুতে যাবে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার উপর সব সময় একজন হেফাযতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান তোমার ধারে কাছেও আসতে পারবে না।” 
সহীহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬১, হাদিস নং- ৫৩০

اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لاَ تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلاَ نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلاَّ بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلاَّ بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاواتِ وَالأَرْضَ وَلاَ يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ

অনুবাদঃ "আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না, নিদ্রাও নয়। আসমানসমূহে যা রয়েছে ও যমীনে যা রয়েছে সবই তাঁর। কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে তা তিনি জানেন। আর যা তিনি ইচ্ছে করেন তা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কোনো কিছুকেই তারা পরিবেষ্টন করতে পারে না। তাঁর ‘কুরসী’ আসমানসমূহ ও যমীনকে পরিব্যাপ্ত করে আছে; আর এ দুটোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর জন্য বোঝা হয় না। আর তিনি সুউচ্চ সুমহান।"

৬। সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া
------------------------------------------------------

آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مِن رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّن رُّسُلِهِ ۚ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا ۖ غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ - 

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۚ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ ۗ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا ۚ أَنتَ مَوْلَانَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ - 

অনুবাদঃ
"রাসূল তার প্রভুর পক্ষ থেকে যা তার কাছে নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহ্র উপর, তাঁর ফেরেশ্তাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলগণের উপর। আমরা তাঁর রাসূলগণের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলে, আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব! আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল।"

" আল্লাহ্ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যাতীত। সে ভাল যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই, আর মন্দ যা কামাই করে তার প্রতিফল তার উপরই বর্তায়। ‘হে আমাদের রব! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না যার সামর্থ আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।"

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি রাতের বেলা সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়বে সেটা তার জন্য যথেষ্ঠ হবে”। সহীহ বুখারিঃ ৫০১০, সহীহ মুসলিমঃ ৮০৭। 

বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ “রিয়াদুস সালেহীন” এর লেখক ও সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার, ইমাম আন-নববী (রহঃ) বলেন, “এর অর্থ কেউ বলেছেনঃ কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ বালা-মুসিবত থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। তবে সবগুলো অর্থ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

৭। সূরা সাজদাহ ও সূরা মুলক পড়া
--------------------------------------------------------
“রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আলিফ লাম মীম তানজিলুল কিতাব (সুরা আস-সাজদা) ও তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা মুলক) তেলাওয়াত না করে কোন দিন ঘুমাতেন না”
সুনানে আত-তিরমিযী ২৮৯২, মুসনাদে আহমাদ ১৪২৯। শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ, সহীহ তিরমিযী ৩/৬

৮। ডান কাত হয়ে ঘুমানো
-----------------------------------
রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 

“যখন তুমি বিছানা গ্রহণ করবে, তখন নামাযের মত ওযু করবে, তারপর তোমার ডান পার্শ্বদেশে শুয়ে পড়বে। তারপর বল,

اللّٰهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِيْ إِلَيْكَ، وَفَوَّضْتُ أَمْرِيْ إِلَيْكَ، وَوَجَّهْتُ وَجْهِيْ إِلَيْكَ، وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِيْ إِلَيْكَ، رَغْبَةً وَّرَهْبَةً إِلَيْكَ، لاَ مَلْجَأَ وَلاَ مَنْجَا مِنْكَ إِلاَّ إِلَيْكَ، آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِيْ أَنْزَلْتَ، وَبِنَبِيِّكَ الَّذِيْ أَرْسَلْتَ 

হে আল্লাহ! আমি নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দিলাম। আমার যাবতীয় বিষয় আপনার কাছেই সোপর্দ করলাম, আমার চেহারা আপনার দিকেই ফিরালাম, আর আমার পৃষ্ঠদেশকে আপনার দিকেই ন্যস্ত করলাম; আপনার প্রতি অনুরাগী হয়ে এবং আপনার ভয়ে ভীত হয়ে। একমাত্র আপনার নিকট ছাড়া আপনার (পাকড়াও) থেকে বাঁচার কোনো আশ্রয়স্থল নেই এবং কোনো মুক্তির উপায় নেই। আমি ঈমান এনেছি আপনার নাযিলকৃত কিতাবের উপর এবং আপনার প্রেরিত নবীর উপর।”

রাসূল (সা) যাকে এ দুয়াটি যাকে শিক্ষা দিয়েন, তাকে বলেন, "যদি তুমি ঐ রাতে মারা যাও তবে ফিতরাত তথা দ্বীন ইসলামের উপর মারা গেলে"।
বুখারী, (ফাতহুল বারীসহ) ১১/১১৩, নং ৬৩১৩; মুসলিম ৪/২০৮১, নং ২৭১০
Collected From: https://dua.gtaf.org/bn

হাদীস: 06


আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

"যে ব্যক্তি দুই’জন স্ত্রী থাকা অবস্থায় তাদের একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ল, ক্বিয়ামাতের দিন সে পঙ্গু অবস্থায় উপস্থিত হবে।"

রেফারেন্সঃ
সুনানে আবু দাউদ, ২১৩৩

Thursday, July 11, 2019

আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
ক্বিয়ামত
ক্বিয়ামত

 লিখেছেনঃ রফীক আহমাদ      

ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার


ক্বিয়ামত হল মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার অলৌকিক শক্তির রূপায়ণ ও নিদর্শন। ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিবেশের কথা জানার জন্য বিশ্ববাসীর চরম আগ্রহের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলা এর সময়কাল গোপন রেখেছেন। কোন নবী-রাসূল বা ফেরেশতারাও এর আসন্ন সময়কাল জানেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিশেষ করে উম্মতে মুহাম্মাদীর অনেকে বিষয়টি বার বার জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলে, আল্লাহ তাআলা এর গোপনীয়তা সংরক্ষণের কথা বিভিন্নভাবে প্রত্যাদেশ করে পৃথিবীবাসীকে অবহিত করেন।
মহান আল্লাহ বলেন,
يَسْأَلُكَ النَّاسُ عَنِ السَّاعَةِ قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللهِ وَمَا يُدْرِيْكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ تَكُوْنُ قَرِيْباً.
লোকেরা আপনাকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, এর জ্ঞান আল্লাহর কাছেই আছে। আপনি কি করে জানবেন যে, সম্ভবতঃ ক্বিয়ামত শীঘ্রই হয়ে যেতে পারে   (আহযাব ৬৩)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَتَبَارَكَ الَّذِيْ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَعِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ.
বরকতময় তিনিই, নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু যাঁর। তাঁরই কাছে আছে ক্বিয়ামতের জ্ঞান এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে   (যুখরুফ ৮৫)

ক্বিয়ামতের গোপনীয়তা রক্ষার ঘোষণায় আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ السَّاعَةَ ءاَتِيَةٌ أَكَادُ أُخْفِيْهَا لِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا تَسْعَى، فَلاَ يَصُدَّنَّكَ عَنْهَا مَنْ لاَ يُؤْمِنُ بِهَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَتَرْدَى-
ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেকেই তার কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের জ্ঞান রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে তা থেকে নিবৃত্ত না করে। নিবৃত্ত হলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে   (ত্ব-হা ১৫-১৬)
একই বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلِلّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلاَّ كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ.
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপন রহস্য আল্লাহর কাছেই রয়েছে। ক্বিয়ামতের ব্যাপারটি তো এমন, যেমন চোখের পলক অথবা তার চাইতেও নিকটবর্তী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান    (নাহল ৭৭)
এ বিষয়ে এরশাদ হচ্ছে,
يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّيْ لاَ يُجَلِّيْهَا لِوَقْتِهَا إِلاَّ هُوَ ثَقُلَتْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
لاَ تَأْتِيْكُمْ إِلاَّ بَغْتَةً يَسْأَلُوْنَكَ كَأَنَّكَ حَفِيٌّ عَنْهَا قُلْ إِنَّمَا عِلْمُهَا عِنْدَ اللهِ وَلَـكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ.
আপনাকে জিজ্ঞেস করে, ক্বিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? বলে দিন, এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। তিনিই তা যথাসময়ে প্রকাশ করবেন। আসমান ও যমীনের জন্য সেটি অতি কঠিন বিষয় হবে। তোমাদের উপর আকস্মিকভাবেই তা এসে যাবে। তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি তার অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এর সংবাদ শুধু আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না    (রাফ ১৮৭)
ক্বিয়ামত দিবস হবে অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয় এক মহাদিবস। মানব সৃষ্টির নেপথ্যে যে মহারহস্য নিহিত আছে, আসন্ন ক্বিয়ামত দিবসের ঘোষণায়ও অনুরূপ আশ্চর্যজনক রহস্য লুক্কায়িত আছে। এর মধ্য দিয়ে ক্বিয়ামতের সর্বোচ্চ ও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সমূহ অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
সর্বশক্তিমান আল্লাহর অসীম কুদরত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও গভীরতর বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে একটা বৃহ দল ধর্মদ্বেষী হয়ে ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। ফলে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয় দলের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দেয়।

সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলা এদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করে প্রত্যাদেশ করেন যে,
إِنَّ السَّاعَةَ لَآتِيَةٌ لاَّ رَيْبَ فِيْهَا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يُؤْمِنُوْنَ
ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস স্থাপন করে না   (মুমিন ৫৯)
মূলতঃ ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসী হচ্ছে কাফের ও মুনাফিকদের দল। কাফেরদের ক্বিয়ামতে অবিশ্বাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসূল (ছাঃ)-কে প্রত্যাদেশ করেন,
وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لاَ تَأْتِيْنَا السَّاعَةُ قُلْ بَلَى وَرَبِّيْ لَتَأْتِيَنَّكُمْ عَالِمِ الْغَيْبِ لاَ يَعْزُبُ عَنْهُ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الْأَرْضِ وَلاَ أَصْغَرُ مِنْ ذَلِكَ وَلاَ أَكْبَرُ إِلاَّ فِيْ كِتَابٍ مُّبِيْنٍ-
কাফেররা বলে, আমাদের উপর ক্বিয়ামত আসবে না। বলুন, আমার পালনকর্তার শপথ! অবশ্যই তোমাদের নিকটে আসবে। তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে তাঁর অগোচর নয় অনুপরিমাণ কিছু, না তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং না বৃহ, সমস্তই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে   (সাবা ৩)
একই বিষয়ে আরো বলা হয়েছে,
قُل لَّكُمْ مِّيْعَادُ يَوْمٍ لاَّ تَسْتَأْخِرُوْنَ عَنْهُ سَاعَةً وَّلاَ تَسْتَقْدِمُوْنَ
বলুন, তোমাদের জন্য একটি দিনের ওয়াদা রয়েছে, যাকে তোমরা এক মুহূর্তও বিলম্বিত করতে পারবে না এবং ত্বরান্বিতও করতে পারবে না    (সাবা ৩০)
কাফেররা ক্বিয়ামতকে একটা মিথ্যা প্রচারণা মনে করে। ফলে তাদের মনে নানারূপ সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাস ভর করে এবং তারা বিভিন্নভাবে একে প্রত্যাখ্যান করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
وَلاَ يَزَالُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فِيْ مِرْيَةٍ مِّنْهُ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ السَّاعَةُ بَغْتَةً أَوْ يَأْتِيَهُمْ عَذَابُ يَوْمٍ عَقِيْمٍ، الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ لِّلَّهِ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ فِيْ جَنَّاتِ النَّعِيْمِ، وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَكَذَّبُوْا بِآيَاتِنَا فَأُوْلَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ-
কাফেররা সর্বদা সন্দেহ পোষণ করবে যে পর্যন্ত না তাদের কাছে আকস্মিকভাবে ক্বিয়ামত এসে পড়ে অথবা এসে পড়ে তাদের কাছে এমন দিবসের শাস্তি, যা থেকে রক্ষার উপায় নেই। রাজত্ব সেদিন আল্লাহরই, তিনিই তাদের বিচার করবেন। অতএব যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সকর্ম সম্পাদন করে তারা নেমতপূর্ণ কাননে থাকবে এবং যারা কুফরী করে এবং আমার আয়াত সমূহকে মিথ্যা বলে তাদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি রয়েছে   (সূরাঃ হাজ্জ ৫৫-৫৭)

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرضِ وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَخْسَرُ الْمُبْطِلُوْنَ-
নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে    (জাছিয়া ২৭)
তিনি আরো বলেন,
وَإِذَا قِيْلَ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ لاَ رَيْبَ فِيْهَا قُلْتُم مَّا نَدْرِيْ مَا السَّاعَةُ إِنْ نَّظُنُّ إِلاَّ ظَنًّا وَمَا نَحْنُ بِمُسْتَيْقِنِيْنَ، وَبَدَا لَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا عَمِلُوْا وَحَاقَ بِهِمْ مَّا كَانُوْا بِهِ يَسْتَهْزِئُوْنَ-
যখন বলা হয়, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং ক্বিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলে থাক আমরা জানি না ক্বিয়ামত কি? আমরা কেবল ধারণাই করি এবং এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তাদের মন্দ কর্মগুলো তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং যে আযাব নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তা তাদেরকে গ্রাস করবে   (জাছিয়া ৩২-৩৩)

বর্তমান বিশ্বে আধুনিক বিজ্ঞানী বা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ঘোষণা দিয়ে আসছেন এবং বিগত কয়েক দশকে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার দিন তারিখও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা এতটুকু কার্যকর হয়নি। অতএব বুঝা যায়, এ পৃথিবীর কোন কিছুই কার্যকর হয় না আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। অবশ্য বিজ্ঞানীদের বর্ণনায় পৃথিবীর ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে ক্বিয়ামতের ধ্বংসযজ্ঞের যসামান্য সাদৃশ্য রয়েছে। বিজ্ঞানীদের এই তথ্যে বর্তমান বিশ্বের জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিনক্ষণ গোপন রেখেছেন। তিনি একদিন তা প্রকাশ করে দেবেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্বিয়ামত শুরু হয়ে যাবে।
পার্থিব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয়ে মানুষের কোন জ্ঞান নেই, যেমন কে কোথায় জন্মগ্রহণ করবে ও মৃত্যুবরণ করবে, আগামী কাল কি ঘটবে, কে ধনী হবে আর কে হবে দরিদ্র, কে হবে ভাগ্যবান আর কে হতভাগ্য, কে হবে অন্ধ, পঙ্গু আর কে হবে সর্বাঙ্গ সুন্দর, আর কখন হবে প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টি, ভূকম্পন ও ভূমিধ্বস ইত্যাদি, কোন মানুষের পক্ষে তা জানা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু ক্বিয়ামতের মতই এগুলো আল্লাহর জানা। তাঁর পক্ষে অসম্ভব বলতে কোন কিছুই নেই।
এ মর্মে আল্লাহ বলেন,
إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَداً وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوْتُ إِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ خَبِيْرٌ-
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ক্বিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন স্থানে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত    (লোকমান ৩৪)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
إِلَيْهِ يُرَدُّ عِلْمُ السَّاعَةِ وَمَا تَخْرُجُ مِنْ ثَمَرَاتٍ مِّنْ أَكْمَامِهَا وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنْثَى وَلاَ تَضَعُ إِلاَّ بِعِلْمِهِ وَيَوْمَ يُنَادِيْهِمْ أَيْنَ شُرَكَائِيْ قَالُوْا آذَنَّاكَ مَا مِنَّا مِنْ شَهِيْدٍ-
ক্বিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই জানা। তাঁর অজ্ঞাতসারে বাইরে কোন ফল আবরণমুক্ত হয় না এবং কোন নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে না। যেদিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, আমার শরীকরা কোথায়? সেদিন তারা বলবে, আমরা আপনার নিকট নিবেদন করি যে, আমরা কিছুই জানি না   (হা-মীম সাজদাহ ৪৭)

মূলতঃ ক্বিয়ামত হবে মানবজীবনের শেষ পরীক্ষা কেন্দ্র। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব জাতিকে এ পার্থিব জগতে আল্লাহর হুকুম মান্য করে এবং শয়তান-এর প্ররোচনা ও পরামর্শ হতে বেঁচে থেকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। যারা আল্লাহর হুকুম বা আদেশ-নিষেধ মেনে পরজগতে পাড়ি জমাতে পারবে, ক্বিয়ামত হবে তাদের জন্য আশীর্বাদ বা অভয় কেন্দ্র।  পক্ষান্তরে যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে শয়তানের মিথ্যা ধোঁকায় পৃথিবীতে নানা অনাচার ও অবিচার করে মৃত্যুবরণ করবে, ক্বিয়ামত তাদের জন্য অভিশাপ, দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে।
নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। তখন কেউ কোন কাজ করার বা কথা বলার সুযোগ পাবে না। ক্বিয়ামতের পূর্বাবস্থার একটি হাদীছ আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করা হল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামত কায়েম হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না দুটি বৃহ দল পরস্পর তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হবে। অথচ তাদের উভয় দলেরই মূল দাবী হবে এক ও অভিন্ন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রায় ত্রিশজন মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করবে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না ধর্মীয় ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে। ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাবে। সময়ের পরিধি সংকীর্ণ হয়ে আসবে। (অর্থা সময় দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাবে) ফিতনা-ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। খুন-খারাবী, হত্যাকান্ড ও মারামারি-হানাহানি অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে। এমনকি তোমাদের মধ্যে ধন-সম্পদের এমন প্রাচুর্য দেখা দেবে যে, সম্পদশালী ব্যক্তি, ধন-সম্পদের মালিক (তার ছাদাক্বা প্রদান করার জন্য) চিন্তিত ও পেরেশান হয়ে পড়বে এজন্য যে, কে তার ছাদাক্বা গ্রহণ করবে? এমনকি যার নিকটই সে মাল উপস্থাপন করা হবে, সে বলে উঠবে আমার এ মালের কোন প্রয়োজন নেই। আর যতক্ষণ না জনগণ সুউচ্চ ও কারুকার্যখচিত ইমারত নির্মাণ কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করবে। যতক্ষণ না কোন ব্যক্তি কোন কবরের নিকট দিয়ে গমন কালে (পরিতাপ করে বলবে) হায়! আমি যদি তার স্থানে হতাম! আর যতক্ষণ না পশ্চিম দিক হতে সূর্য উদিত হবে। অতঃপর সূর্য (পশ্চিম দিক হতে) উদিত হলে জনগণ তা প্রত্যক্ষ করে সকলেই (আল্লাহর প্রতি) ঈমান আনয়ন করবে।কিন্তু
لاَ يَنفَعُ نَفْساً إِيْمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِيْ إِيْمَانِهَا خَيْرًا-
এখনকার ঈমান কোন লোকেরই উপকারে আসবে না। যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা ঈমানদার অবস্থায় কোন স ও ন্যায় কাজ করেনি   (আনআম ১৫৮)
আর ক্বিয়ামত এমন পরিস্থিতি ও এমন অবস্থায় কায়েম হবে যে, দুব্যক্তি (ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রেতাদের সম্মুখে) কাপড় ছড়িয়ে ও খুলে বসবে। কিন্তু সে কাপড় ক্রয়-বিক্রয় কিংবা ছড়ান কাপড়টা গুটিয়ে নেয়া বা ভাঁজ করারও সুযোগ পাবে না। আর ক্বিয়ামত এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে অবশ্যই কায়েম হবে যে, এক ব্যক্তি উট দোহন করে নিয়ে আসবে, কিন্তু সে তা পান করারও সুযোগ পাবে না। ক্বিয়ামত অবশ্যই কায়েম হবে এমতাবস্থায় যে, এক ব্যক্তি তার পশুর জন্য চৌবাচ্চা বা জলাধার মেরামত বা নির্মাণ করতে থাকবে। কিন্তু তাতে সে পানি পান করাবার সুযোগ পাবে না। আর ক্বিয়ামত এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে অবশ্যই কায়েম হবে যে, এক ব্যক্তি খাদ্যের লোকমা বা গ্রাস তার মুখ পর্যন্ত উত্তোলন করবে কিন্তু সে তা খাওয়া ও গলধঃকরণ করার সুযোগ পাবে না।    (বুখারী)

ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে নিম্নে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হল। মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيْمٌ، يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ  كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللهِ شَدِيْدٌ-
হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই  ক্বিয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী তার দুধের শিশুকে বিস্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল। অথচ তারা মাতাল নয়, বস্ত্ততঃ আল্লাহর আযাব  অত্যন্ত কঠিন   (হাজ্জ ১-২)
মহান আল্লাহ বলেন,
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّوْرِ نَفْخَةٌ وَاحِدَةٌ، وَحُمِلَتِ الْأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً، فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ، وَانْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَهِيَ يَوْمَئِذٍ وَاهِيَةٌ، وَالْمَلَكُ عَلَى أَرْجَائِهَا وَيَحْمِلُ عَرْشَ رَبِّكَ فَوْقَهُمْ يَوْمَئِذٍ ثَمَانِيَةٌ-
যখন শিংগায় ফুকার দেয়া হবে একটি মাত্র ফুকার এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে এবং এক ধাক্কায় তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, সেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়বে এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আটজন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে    (হাক্বকাহ ১৩-১৭)
অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَلاَ أَنْسَابَ بَيْنَهُمْ يَوْمَئِذٍ وَلاَ يَتَسَاءَلُوْنَ، فَمَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِيْنُهُ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ، وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِيْنُهُ فَأُوْلَئِكَ الَّذِيْنَ خَسِرُوْا أَنْفُسَهُمْ فِيْ جَهَنَّمَ خَالِدُوْنَ-
অতঃপর যখন সিংগায় ফুকার দেয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে, তারা জাহান্নামেই চিরকাল বসবাস করবে   (মুমিনূন ১০১-১০৩)
ক্বিয়ামত দিবসের প্রথম নিদর্শনই হবে সিংগায় ফুকারের বিকট আওয়াজ। সিংগায় এই ফুকারের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। পাহাড়-পর্বত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে ধূলিকণার ন্যায় উড়ে বেড়াবে, আকাশ ও পৃথিবী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীছ দ্বারা ক্বিয়ামতে শিংগায় দুইটি ফুকার প্রমাণিত হয়। প্রথম ফুকারে ধ্বংস অনিবার্য যা উপরের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর দ্বিতীয়বার সিংগায় ফুকার দেয়া হবে। ফলে অকস্মা সব মৃত জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহর পানে ধাবিত হবে।
এমর্মে মহান আল্লাহর বাণী,
وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَن فِي الْأَرْضِ إِلاَّ مَن شَاءَ اللهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيْهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُوْنَ-
সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ক্ষণা তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে   (যুমার ৬৮)
একইভাবে অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে,
وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ فَإِذَا هُم مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُوْنَ، قَالُوْا يَا وَيْلَنَا مَنْ بَعَثَنَا مِنْ مَّرْقَدِنَا هَذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُوْنَ-
সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভাগ্য! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল? রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন    (ইয়াসীন ৫১-৫২)
একই বিষয়ে মহান আল্লাহ আরও বলেন,
وَيَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّوْرِ فَفَزِعَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلاَّ مَنْ شَاءَ اللهُ وَكُلٌّ أَتَوْهُ دَاخِرِيْنَ-
যেদিন সিংগায় ফুকার দেওয়া হবে, অতঃপর আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করবেন, তারা ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা সবাই ভীত-বিহবল হয়ে পড়বে এবং সকলেই তার কাছে আসবে বিনীত অবস্থায়   (নামল ৮৭)
যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাই ক্বিয়ামতে সফলকাম হবে। পক্ষান্তরে যারা ক্বিয়ামতকে মিথ্যা ভাববে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহকে অবিশ্বাস করবে, তারা ক্বিয়ামতে কোপানলে পতিত হবে। এজন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর সকল বান্দাকে সঠিকভাবে ক্বিয়ামতের বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা তাঁর মহামূল্যবান আদেশ সমূহকে একাধিকবার বা বহুবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রত্যাদেশ করেছেন। তন্মধ্যে ক্বিয়ামতের ভীতিকর ও আতংকজনক আলোচনা নিঃসন্দেহে অন্যতম। ক্বিয়ামতের অচিন্তনীয় ও নিদারুণ শাস্তির প্রেক্ষাপটেই দয়াশীল আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের বহুমুখী আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির সেরা বস্ত্তগুলির নামে বার বার শপথ করে প্রত্যাদেশ করতে থাকেন বান্দার হৃদয়ে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَالنَّازِعَاتِ غَرْقاً، وَالنَّاشِطَاتِ نَشْطاً، وَالسَّابِحَاتِ سَبْحاً، فَالسَّابِقَاتِ سَبْقاً، فَالْمُدَبِّرَاتِ أَمْراً، يَوْمَ تَرْجُفُ الرَّاجِفَةُ، تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ، قُلُوْبٌ يَوْمَئِذٍ وَاجِفَةٌ، أَبْصَارُهَا خَاشِعَةٌ-
শপথ সেই ফেরেশতাগণের, যারা ডুব দিয়ে আত্মা উপাটন করে। শপথ তাদের, যারা আত্মার বাঁধন খুলে দেয় মৃদুভাবে। শপথ তাদের, যারা সন্তরণ করে দ্রুতগতিতে, শপথ তাদের যারা দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয় এবং শপথ তাদের, যারা সকল কর্মনির্বাহ করে। যেদিন প্রকম্পিত করবে প্রকম্পিতকারী, অতঃপর পশ্চাতে আসবে পশ্চাদগামী, সেদিন অনেক হৃদয় ভীত-বিহবল হবে। তাদের দৃষ্টি নত হবে   (নাযিআত ১-৯)
ক্বিয়ামতের অপরিসীম দৃঢ়তা ব্যক্ত করে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
وَالْمُرْسَلاَتِ عُرْفاً، فَالْعَاصِفَاتِ عَصْفاً، وَالنَّاشِرَاتِ نَشْراً، فَالْفَارِقَاتِ فَرْقاً، فَالْمُلْقِيَاتِ ذِكْراً، عُذْراً أَوْ نُذْراً، إِنَّمَا تُوْعَدُوْنَ لَوَاقِعٌ، فَإِذَا النُّجُوْمُ طُمِسَتْ، وَإِذَا السَّمَاءُ فُرِجَتْ، وَإِذَا الْجِبَالُ نُسِفَتْ، وَإِذَا الرُّسُلُ أُقِّتَتْ، لِأَيِّ يَوْمٍ أُجِّلَتْ، لِيَوْمِ الْفَصْلِ-
কল্যাণের জন্য প্রেরিত বায়ুর শপথ, সজোরে প্রবাহিত ঝটিকার শপথ, মেঘ বিস্তৃতকারী বায়ুর শপথ, মেঘপুঞ্জ বিতরণকারী বায়ুর শপথ এবং অহী নিয়ে অবতরণকারী ফেরেশতাগণের শপথ, ওযর-আপত্তির অবকাশ না রাখার জন্য অথবা সতর্ক করার জন্য; নিশ্চয়ই তোমাদেরকে প্রদত্ত ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। অতঃপর যখন  নক্ষত্রসমূহ নির্বাপিত হবে, যখন আকাশ ছিদ্রযুক্ত হবে, যখন পর্বতমালাকে উড়িয়ে দেয়া হবে এবং যখন রাসূলগণের একত্রিত হওয়ার সময় নিরূপিত হবে, এসব বিষয় কোন দিবসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে? বিচার দিবসের (ক্বিয়ামতের) জন্য   (মুরসালাত ১-১৩)
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
لاَ أُقْسِمُ بِيَوْمِ الْقِيَامَة، وَلاَ أُقْسِمُ بِالنَّفْسِ اللَّوَّامَةِ، أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ أَلَّنْ نَجْمَعَ عِظَامَهُ، بَلَى قَادِرِيْنَ عَلَى أَنْ نُّسَوِّيَ بَنَانَهُ، بَلْ يُرِيْدُ الْإِنْسَانُ لِيَفْجُرَ أَمَامَهُ، يَسْأَلُ أَيَّانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ، وَخَسَفَ الْقَمَرُ، وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ، يَقُوْلُ الْإِنْسَانُ يَوْمَئِذٍ أَيْنَ الْمَفَرُّ، كَلاَّ لاَ وَزَرَ، إِلَى رَبِّكَ يَوْمَئِذٍ الْمُسْتَقَرُّ، يُنَبَّأُ الْإِنْسَانُ يَوْمَئِذٍ بِمَا قَدَّمَ وَأَخَّرَ-
আমি শপথ করি ক্বিয়ামত দিবসের, আরও শপথ করি সেই মনের, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়। মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করব না? পরন্তু আমি তার অঙ্গুলিগুলো পর্যন্ত সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম। বরং মানুষ তার ভবিষ্য জীবনেও পাপাচার করতে চায়। সে প্রশ্ন করে, ক্বিয়ামত দিবস কবে? যখন দৃষ্টি চমকে যাবে, চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে যাবে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। সেদিন মানুষ বলবে, পলায়নের জায়গা কোথায়? না কোথাও আশ্রয়স্থল নেই, আপনার পালনকর্তার কাছেই সেদিন ঠাঁই হবে। সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে, সে যা সামনে প্রেরণ করেছে ও পশ্চাতে ছেড়ে দিয়েছে   (ক্বিয়ামাহ ১-১৩)
অতঃপর মানুষকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং সে জানতে পারবে নিজের স ও অস কর্মের হিসাব। অপরাধীরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَنَضَعُ الْمَوَازِيْنَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيَامَةِ فَلاَ تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئاً وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِيْنَ-
আমি ক্বিয়ামতের দিন ন্যায়-বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি সামান্যতম যুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট   (আম্বিয়া ৪৭)
অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يُبْلِسُ الْمُجْرِمُوْنَ
যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে যাবে   (রূম ১২)
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُوْنَ مَا لَبِثُوْا غَيْرَ سَاعَةٍ كَذَلِكَ كَانُوْا يُؤْفَكُوْنَ-
যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম খেয়ে বলবে যে, এক মুহূর্তেরও বেশী অবস্থান করিনি। এমনিভাবে তারা সত্য বিমুখ হ    (রূম ৫৫)
ক্বিয়ামত দিবসের প্রতিকূল পরিবেশে অপরাধীদের বাস্তব অবস্থার বর্ণনা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

وَلَوْ أَنَّ لِلَّذِيْنَ ظَلَمُوْا مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيْعاً وَمِثْلَهُ مَعَهُ لاَفْتَدَوْا بِهِ مِنْ سُوْءِ الْعَذَابِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَبَدَا لَهُمْ مِّنَ اللهِ مَا لَمْ يَكُوْنُوْا يَحْتَسِبُوْنَ، وَبَدَا لَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوْا وَحَاقَ بِهِم مَّا كَانُوْا بِهِ يَسْتَهْزِئُوْن-


যদি গোনাহগারদের কাছে পৃথিবীর সবকিছু থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে, তবে অবশ্যই তারা ক্বিয়ামতের দিন সে সবকিছুই নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মুক্তিপণ হিসাবে দিয়ে দিবে। অথচ তারা দেখতে পাবে; আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এমন শাস্তি, যা তারা কল্পনাও করত না। আর দেখবে তাদের দুষ্কর্ম সমূহ এবং যে বিষয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। তা তাদেরকে ঘিরে নিবে   (যুমার ৪৭-৪৮)
  এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) থেকে একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,
আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের দিন সবচেয়ে কম আযাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বলবেন, যদি গোটা পৃথিবী পরিমাণ সম্পদ থাকত তবে কি তুমি সে সমুদয়ের বিনিময়ে এ আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতে? সে বলবে, হ্যাঁ। আল্লাহ বলবেন, আদমের ঔরসে থাকাকালে এর চেয়েও সহজ বিষয়ের হুকুম করেছিলাম যে, আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তুমি তা অমান্য করেছ এবং আমার সাথে শরীক করেছ   (বুখারী)
পবিত্র কুরআনে ক্বিয়ামতের বর্ণনা নানাভাবে নানা পর্যায়ে উল্লিখিত হয়েছে। তবে এসব বর্ণনার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল ক্বিয়ামতের প্রতি বিদ্যমান অবিশ্বাস হতে মানব জাতিকে ফিরিয়ে আনা। কুরআন আল্লাহ তাআলার গুণাবলী, রহমত, ছওয়াব, গযব ও আযাবের অদ্বিতীয় স্মারক। এজন্য ক্বিয়ামতের মহা নিনাদ, ভয়ঙ্কর গর্জন, ভীতিকর পরিবেশ ইত্যাদির মাঝে হিসাব-নিকাশ এবং প্রতিদান ও শাস্তির যে ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। অতঃপর বাস্তবায়ন মুহূর্তের কতিপয় অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, অপরাধীরা তাদের দীর্ঘজীবনের অপকর্মের সময়কে খুবই সল্প সময় হিসাবে ব্যক্ত করে স্বস্তি লাভের চেষ্টা করবে। এক পর্যায়ে গোনাহগাররা পৃথিবীর সব ধন-সম্পদের বিনিময়েও আল্লাহ্র কঠোর আযাব হতে রক্ষা লাভের জন্য প্রলাপ করবে। এসব বিষয় উপরের আয়াতে সংক্ষেপে উপস্থাপিত হয়েছে। এই পাপী কাফেরদের জন্য রয়েছে শিকল, বেড়ি ও জাহান্নাম।
আর মুমিন ও ইবাদতকারীদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত নেমত, যা তারা কল্পনা করতে পারবে না।
 এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، أَفَمَنْ كَانَ مُؤْمِناً كَمَنْ كَانَ فَاسِقاً لَّا يَسْتَوُوْنَ، أَمَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلاً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، وَأَمَّا الَّذِيْنَ فَسَقُوْا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ كُلَّمَا أَرَادُوْا أَنْ يَخْرُجُوْا مِنْهَا أُعِيْدُوْا فِيْهَا وَقِيْلَ لَهُمْ ذُوْقُوْا عَذَابَ النَّارِ الَّذِيْ كُنتُمْ بِهِ تُكَذِّبُوْنَ-

কেউ জানে না তার জন্য কৃতকর্মের কি কি নয়ন প্রীতিকর প্রতিদান লুক্কায়িত আছে। ঈমানদার ব্যক্তি কি অবাধ্যের অনুরূপ? তারা সমান নয়, যারা ঈমান আনে ও সকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে তাদের কৃতকর্মের আপ্যায়ন স্বরূপ বসবাসের জান্নাত। পক্ষান্তরে যারা অবাধ্য হয়, তাদের ঠিকানা জাহান্নাম   (সাজদাহ ১৭-২০)
মানব জাতির জন্য আল্লাহপাক বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্ত্ত অতি সুন্দর ও নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন। একইভাবে মানবের শ্রেষ্ঠত্ব বিকাশের জন্য এক বিশাল ও বিপুলায়তনের অন্তর্জগতও সৃষ্টি করেছেন নিখুঁত ও নিরঙ্কুশভাবে। এই অন্তর্জগতই হল মানুষের সম্মান, খ্যাতি ও যশের একমাত্র লীলাভূমি। আবার কলংক, অধঃপন ও অমর্যাদার অতল তলে তলিয়ে যাওয়ারও পথ। সমগ্র বিশ্বজগতের অসীম অনন্ত ও অবাধ্য পরিবেশের চেয়ে, ব্যক্তিগত অন্তর্জগতের সীমাবদ্ধ ও বাধ্যগত পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ তুলনামূলক অনেক সহজ। এজন্য মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাআলা তাঁকে সার্বক্ষণিকভাবে স্মরণ করার জন্য মানুষকে বার বার আহবান জানিয়েছেন। অতঃপর যারা আল্লাহকে স্মরণ করে তারা, তাঁর সন্তুষ্টি লাভে সমর্থ হয় এবং সপথ প্রাপ্ত হয়। অপরদিকে যারা শয়তান-এর প্ররোচনায় আল্লাহ্র স্মরণ ভুলে যায় বা অগ্রাহ্য করে, আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ফলে তারা জাহান্নামের আমল করে নিজেদের ধ্বংস করে। ক্বিয়ামতে আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে অন্ধ করে উঠাবেন।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِيْ فَإِنَّ لَهُ مَعِيْشَةً ضَنْكاً وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى، قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْ أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْراً، قَالَ كَذَلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيْتَهَا وَكَذَلِكَ الْيَوْمَ تُنْسَى-

যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে ক্বিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াত সমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। অতএব তোমাকে আজ ভুলে যাব    (ত্বোয়া-হা ১২৪-১২৬)
একইভাবে অন্যত্র বলা হয়েছে যে,

يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ أَلْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيْهِمْ وَأَرْجُلُهُم بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، يَوْمَئِذٍ يُوَفِّيْهِمُ اللهُ دِيْنَهُمُ الْحَقَّ وَيَعْلَمُوْنَ أَنَّ اللهَ هُوَ الْحَقُّ الْمُبِيْنُ-

যেদিন প্রকাশ করে দিবে তাদের জিহবা, তাদের হাত ও তাদের পা যা কিছু তারা করত। সেদিন আল্লাহ তাদের সমুচিত শাস্তি পুরোপুরি দিবেন এবং তারা জানতে পারবে যে, আল্লাহই সত্য স্পষ্ট ব্যক্তকারী   (নূর ২৪-২৫)

আলোচ্য বিষয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়াসে আল্লাহ তাআলা পুনরায় প্রত্যাদেশ করেন,

وَيَوْمَ يُحْشَرُ أَعْدَاءَ اللهِ إِلَى النَّارِ فَهُمْ يُوْزَعُوْنَ، حَتَّى إِذَا مَا جَاؤُوْهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُوْدُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ، وَقَالُوْا لِجُلُوْدِهِمْ لِمَ شَهِدتُّمْ عَلَيْنَا قَالُوْا أَنْطَقَنَا اللهُ الَّذِيْ أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ، وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُوْنَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلاَ أَبْصَارُكُمْ وَلاَ جُلُوْدُكُمْ وَلَكِنْ ظَنَنتُمْ أَنَّ اللهَ لاَ يَعْلَمُ كَثِيْراً مِّمَّا تَعْمَلُوْنَ-

যেদিন আল্লাহর শত্রুদেরকে অগ্নিকুন্ডের দিকে ঠেলে নেওয়া হবে এবং ওদের বিন্যস্ত করা হবে বিভিন্ন দলে। তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে, তখন তাদের কান, চক্ষু ও ত্বক তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবে। তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সবকিছুর বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। তোমাদের কান, তোমাদের চক্ষু এবং তোমাদের ত্বক তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে না, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে তোমরা তাদের কাছে কিছু গোপন করতে না। তবে তোমাদের ধারণা ছিল যে, তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না   (হা-মীম-সাজদাহ ১৯-২২)
ক্বিয়ামত হবে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম (আঃ) হতে শুরু করে শেষ দিবসের শেষ মানুষ পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সমস্ত মানুষের মিলন কেন্দ্র, পরীক্ষা কেন্দ্র তথা বিচার কেন্দ্র। সেখানে যা ঘটবে তার একটি ছোট্ট নমুনা। যা উপরের আয়াতে সকল মানবের অবগতির জন্য বর্ণিত হয়েছে। মানুষের হাত, পা, কান, চোখ, ত্বক ইত্যাদি তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে, এটা অবশ্যই বিস্ময়কর। ঐ দিন সকল মানুষ ক্বিয়ামতের ময়দানে সমবেত হবে, কেউ অনুপস্থিত থাকতে পারবে না এবং সকলকে একাকী অবস্থায় আল্লাহর দরবারে হাযির হতে হবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنْ كُلُّ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِلَّا آتِيَ الرَّحْمَنِ عَبْداً، لَقَدْ أَحْصَاهُمْ وَعَدَّهُمْ عَدّاً، وَكُلُّهُمْ آتِيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَرْداً-

নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহ্র কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না। তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। ক্বিয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে    (মারিয়াম ৯৩-৯৫)


অতঃপর ঐদিন আল্লাহ তাআলা সুদীর্ঘ সময়ের বিপুল সংখ্যক মানুষের খতিয়ান বহিঃপ্রকাশ করে দিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। মহিমাময় পরওয়ারদেগার তাঁর অলৌকিক শক্তিতে বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন। মানুষের কর্ম অনুযায়ী তাদেরকে পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত করা হবে। অতঃপর তাদের কর্মফল অনুযায়ী তাদের কারো ডান হাতে ও কারো বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে। ডান হাতে আমলনামাপ্রাপ্তরা হবে সৌভাগ্যবান এবং বাম হাতে আমলনামাপ্রাপ্তরা হবে দুর্ভাগ্যবান।

এদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন,

فَأَمَّا مَنْ أُوْتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ، فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَاباً يَسِيراً، وَيَنْقَلِبُ إِلَى أَهْلِهِ مَسْرُوْراً، وَأَمَّا مَنْ أُوْتِيَ كِتَابَهُ وَرَاءَ ظَهْرِهِ، فَسَوْفَ يَدْعُوْ ثُبُوْراً، وَيَصْلَى سَعِيْراً-

যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, তার হিসাব-নিকাশ সহজ হয়ে যাবে এবং সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যাবে। আর যাকে তার আমলনামা পিছনদিক থেকে দেয়া হবে, সে মৃত্যুকে আহবান করবে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করবে    (ইনশিক্বাক্ব ৭-১২)

ক্বিয়ামত দিবস অবিশ্বাসী ও কাফেরদের জন্য হবে মারাত্মক, তারা প্রত্যেকেই তার কাজকর্ম স্বচক্ষে দেখতে পাবে; হয় আমলনামা হাতে আসার পরে দেখবে, না হয় কাজকর্ম সব স্বশরীরী হয়ে সামনে এসে যাবে। ফলে ক্বিয়ামতের অলৌকিক দৃশ্য কাফেরদের সামনে হাযার বছরের সমতুল্য মনে হবে। পক্ষান্তরে সকর্মপরায়ণদের সামনে এর কোন প্রভাবই পড়বে না।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِيْ يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِّمَّا تَعُدُّوْنَ، ذَلِكَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيْزُ الرَّحِيْمُ-

তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত সমস্ত কর্ম পরিচালনা করেন। অতঃপর তা তাঁর কাছে পৌছবে এমন এক দিনে, যার পরিমাণ তোমাদের গণনায় হাযার বছরের সমান। তিনিই দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু   (সাজদাহ ৫-৬)

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,

تَعْرُجُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوْحُ إِلَيْهِ فِيْ يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِيْنَ أَلْفَ سَنَةٍ

ফেরেশতাগণ এবং রূহ আল্লাহ তাআলার দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে, যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাযার বছর    (মাআরিজ ৪)
ক্বিয়ামতে সীমালংঘনকারীরাই সর্বাধিক আতংক, কণ্ঠা ও হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হবে। কাফের, মুনাফিক ও অবিশ্বাসীরাও আতংকগ্রস্ত থাকবে এবং অপরাধের পরিমাণ অনুযায়ী ঘামের মধ্যে ডুবে থাকবে। অতীত জীবনের স্থায়িত্ব কালকে খুবই সামান্য সময় হিসাবে ব্যক্ত করবে। তাদের সেই উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে আল্লাহ তাআলা বান্দার অবগতির জন্য বাণী অবতীর্ণ করেন,

كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْا إِلاَّ عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا

যেদিন তারা (কাফেররা) একে (ক্বিয়ামত) দেখবে, সেদিন মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক সকাল অবস্থান করেছে    (নাযিআত ৪৬)
একই বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلاَ تَسْتَعْجِل لَّهُمْ كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَ مَا يُوْعَدُوْنَ لَمْ يَلْبَثُوْا إِلاَّ سَاعَةً مِّن نَّهَارٍ بَلاَغٌ فَهَلْ يُهْلَكُ إِلاَّ الْقَوْمُ الْفَاسِقُوْنَ-

ওদেরকে (কাফেরদের) সে বিষয়ে ওয়াদা দেয়া হ, তা সেদিন তারা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন তাদের মনে হবে, যেন তারা দিনের এক মুহূর্তেরও বেশী পৃথিবীতে অবস্থান করেনি। এটা সুস্পষ্ট অবগতি। এখন তারাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, যারা পাপাচারী সম্প্রদায়   (আহক্বাফ ৩৫)

এ বিষয়ে মুমিনদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মহান আল্লাহ বলেন,

إِنِّيْ جَزَيْتُهُمُ الْيَوْمَ بِمَا صَبَرُوْا أَنَّهُمْ هُمُ الْفَائِزُوْنَ، قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِيْنَ، قَالُوْا لَبِثْنَا يَوْماً أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ فَاسْأَلْ الْعَادِّيْنَ-

আজ আমি তাদেরকে তাদের ছবরের কারণে এমন প্রতিদান দিয়েছি যে, তারাই সফলকাম। আল্লাহ বলবেন, তোমরা পৃথিবীতে কতদিন অবস্থান করলে বছরের গণনায়? তারা বলবে, আমরা একদিন অথবা দিনের কিছু অংশ অবস্থান করেছি। অতএব আপনি গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করুন    (মুমিনূন ১১১-১১৩)
ক্বিয়ামত দিবসের সর্বশেষ অবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করে বিশ্বনবী (ছাঃ)-এর একটি হাদীছের উদ্ধৃতি দেয়া হল। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,
আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামতের দিন কি আমরা আমাদের রবকে দেখতে পাব? তিনি বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে তোমরা সূর্য দেখতে কি কষ্ট পাও? আমরা বললাম, না। তিনি বললেন, মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য দেখতে তোমাদের যতটুকু কষ্ট হয়, তোমাদের রবকে দেখতেও তোমাদের ততটুকু কষ্ট হবে মাত্র। তারপর তিনি বললেন, সেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) একজন ঘোষক ঘোষণা করে বলবে যে, যারা যে জিনিসের  ইবাদত করতে, তারা সেই জিনিসের সাথে হয়ে যাও। সুতরাং ক্রুশধারীরা ক্রুশের সাথে চলে যাবে, মূর্তিপূজকরা মূর্তির সাথে হয়ে যাবে। এভাবে প্রতি মাবূদের অনুসারীরা তাদের উপাস্যের কাছে যাবে। তারপর যারা একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করত, তারাই শুধু অবশিষ্ট থাকবে। তারা গোনাহগার বা নেককার যাই হোক না কেন। সাথে সাথে আহলে কিতাবদের অবশিষ্ট কিছু লোকও থাকবে। এরপর জাহান্নামকে সামনে আনা হবে। তা মরীচিকার মত মনে হবে। তখন ইহুদীদের বলা হবে, তোমরা কিসের ইবাদত করতে? তারা বলবে আমরা আল্লাহ্র বেটা উযায়েরের ইবাদত করতাম। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা মিথ্যা কথা বলছ। আল্লাহ্র তো কোন স্ত্রী বা সন্তান ছিল না। (তাদেরকে পুনরায় বলা হবে) তোমরা এখন কি চাও? তারা বলবে, আমরা চাই আপনি আমাদের পানি পান করতে দিন। বলা হবে ঠিক আছে, পানি পান করে নাও। তারপর তারা জাহান্নামের মধ্যে পড়ে যাবে। এরপর নাছারা (খৃষ্টান)-দেরকে বলা হবে, তোমরা কিসের ইবাদত করতে? তারা বলবে, আমরা আল্লাহ্র বেটা (ঈসা) মসীহের ইবাদত করতাম। তাদের বলা হবে, তোমরা মিথ্যা কথা বললে। আল্লাহ্র তো স্ত্রী বা সন্তান ছিল না। (তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে) তোমরা এখন কি চাও? তারা বলবে, আমরা চাই আপনি আমাদেরকে পানি পান করতে দিন। তাদেরকে বলা হবে, ঠিক আছে পান করে নাও। তারপর তারা জাহান্নামের মধ্যে পড়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে একমাত্র আল্লাহ্র ইবাদতকারীরা। তাদের মধ্যে নেককারও থাকবে, গোনাহগারও থাকবে। তাদের বলা হবে, সব লোক তো চলে গেছে, কিন্তু তোমাদেরকে কিসে বসিয়ে রেখেছে? তারা বলবে, আমরা তো তখনই তাদেরকে বর্জন করেছিলাম, যখন আজকের চাইতে তাদের বেশী প্রয়োজন ছিল। আমরা এমর্মে একজন ঘোষকের ঘোষণা শুনেছি যে, যে কওম যার জিনিসের ইবাদত করত, সেই কওম তার সাথে হয়ে যাও। আমরা (সেই ঘোষণা অনুসারে) আমাদের রবের জন্য অপেক্ষা করছি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, এরপর মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ তাদের কাছে আসবেন। কিন্তু প্রথমবার ঈমানদারগণ যে আকৃতিতে তাঁকে দেখেছিলেন তিনি সেই আকৃতিতে আসবেন না। তিনি (এসে) বলবেন, আমি তোমাদের রব! সবাই বলবে, হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব। (সে সময়) নবীগণ ছাড়া আর কেউ তাঁর সাথে কথা বলবেন না। তোমরা কি তাঁর কোন চিহ্ন জান? তারা বলবে, সাক বা পায়ের নলার তাজাল্লী। সেই সময় সাক খুলে দেয়া হবে। তখন সব ঈমানদারই সিজদায় পড়ে যাবে। তবে যারা প্রদর্শনীর জন্য আল্লাহকে সিজদা করতো তারা থেকে যাবে। তার সেই সময় সিজদা করতে চাইলে, তাদের মেরুদন্ডের হাড় শক্ত হয়ে একটি তক্তার ন্যায় হয়ে যাবে। (তাই তারা সিজদা করতে পারবে না)।
তারপর পুলছিরাত এনে জাহান্নামের উপরে পাতা হবে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! পুল বা পুলছিরাত কি? তিনি বললেন, পিচ্ছিল জায়গা, যার উপর লোহার হূক এবং চওড়া ও বাঁকা কাঁটা থাকবে যা নজদের সাদান গাছের কাঁটার মতো। মুমিনগণ এ পুলছিরাতের উপর দিয়ে কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যু গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে এবং কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে অতিক্রম করবে। কেউ ছহীহ-সালামতে বেঁচে যাবে, আবার কেউ এমনভাবে পার হয়ে আসবে যে, তার দেহ জাহান্নামের আগুনে ঝলসে যাবে। এমনকি সর্বশেষ ব্যক্তি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে কোন রকমে অতিক্রম করবে। আজ তোমরা হকের দাবীতে আমার তুলনায় ততখানি কঠোর নও, যতখানি কঠোর সেদিন (ক্বিয়ামতের দিন) ঈমানদারগণ প্রতাপশালী আল্লাহর কাছে হবে।
(আর তোমরা যে হকের দাবীতে আমার চাইতে বেশী কঠোর নও তা তো) তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। যখন তারা (ঈমানদারগণ) দেখবে যে, তাদের ভাইদের মধ্যে তারাই শুধু নাজাত পেয়েছে, তখন তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমাদের সেই সব ভাইয়েরা কোথায়, যারা আমাদের সাথে ছালাত পড়ত, ছিয়াম পালন করত ও নেক আমল করত? আল্লাহ বলবেন, যাও, যাদের অন্তরে এক দীনার পরিমাণ ঈমান পাবে, তাদের (জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করে আনো। আল্লাহ তাদের আকৃতিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন। তাদের কারো দুপা ও পায়ের নলা পর্যন্ত জাহান্নামের আগুনে ডুবে থাকবে। তারা (ঈমানদারগণ) যাদেরকে চিনতে পারবে তাদেরকে (জাহান্নাম থেকে) বের করে আনবে। তারপর ফিরে আসলে আল্লাহ তাআলা বলবেন, যাও যাদের অন্তরে অর্ধ দীনার পরিমাণ ঈমান দেখতে পাবে তাদেরকেও বের করে আন। সুতরাং তারা যাদেরকে চিনতে পারবে তাদেরকে মুক্ত করবে এবং তারপর ফিরে আসলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বলবেন, যাও যাদের হৃদয়ে একবিন্দু পরিমাণ ঈমান পাবে তাদেরকে বের করে আনো। সুতরাং (এবারও) তারা যাদেরকে চিনবে তাদেরকে মুক্ত করে আনবে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না করো তাহলে ইচ্ছা করলে কুরআন মজীদের এ আয়াতটি পাঠ করো (তাতে একথার সত্যতার সমর্থন পাবে)। আল্লাহ (কারো প্রতি) একবিন্দু পরিমাণ যুলুমও করেন না। বরং কোন নেকীর কাজ হলে তিনি তা দ্বিগুণ করে দেন। এভাবে নবী, ফেরেশতা এবং ঈমানদারগণ শাফাআত বা সুপারিশ করবেন।
তারপর পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলা বলবেন, এখন একমাত্র আমার শাফাআতই অবশিষ্ট আছে। তিনি এক মুষ্টি ভরে জাহান্নাম থেকে একদল লোককে বের করবেন, যাদের গায়ের চামড়া পুড়ে কাল হয়ে গেছে। তারপর তাদেরকে জান্নাতের সম্মুখ ভাগে অবস্থিত হায়াতনামক একটি নহরে নামানো হবে। তারা এর দুতীরে এমনভাবে তরতাজা হয়ে উঠবে, যেমন তোমরা পাথর বা গাছের পাশ দিয়ে প্রবাহিত স্রোতের কিনারে বীজকে দ্রুত অঙ্কুরোদ্গম করতে দেখ। এর মধ্যে যেটা রোদে থাকে সেটা সবুজ হয়, আর যেটা ছায়ায় থাকে সেটা সাদা হয়। তাদেরকে সেখান থেকে বের করা হবে। তখন তাদেরকে মোতির দানার মত মনে হবে। তাদের গলায় সীলমোহর লাগান হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করলে জান্নাতবাসীরা বলবে, এরা পরম দয়ালু আল্লাহ্র মুক্ত করা লোক। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত দিয়েছেন, অথচ (এজন্য) তারা কোন আমল বা কল্যাণের কাজ করেনি। (জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে) তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যা দেখছো তা তোমাদেরকে দেয়া হল এবং অনুরূপ পরিমাণ আরও দেয়া হ   (বুখারী)
ক্বিয়ামত সম্পর্কিত আলোচনার শেষ প্রান্তে বর্ণিত হাদীছটি মোটামুটি ভাবে মানবমন্ডলীর সর্বব্যাপক কর্মকান্ডের বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছে। মহানবী (ছাঃ) ক্বিয়ামত সম্পর্কিত বিপুলসংখ্যক আয়াতগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেই উপরের সংক্ষিপ্ত হাদীছটির অবতারণা করেন। আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী ধর্মীয় তত্ত্বের মেরুদন্ডে আঘাত হেনে অসংখ্য মাবূদের ইবাদতে আত্মোসর্গকারীদের পরিণতির পৃথক পৃথক ইতিহাস হাদীছটিতে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া এক মাবূদের ইবাদতকারীদের মধ্যে খাঁটি মুমিন এবং তুলনামূলকভাবে কিছু ত্রুটিযুক্ত মুমিন এবং আরও সামান্য ঈমান ওয়ালা মুমিনের সর্বশেষ অবস্থার বাস্তব চিত্রও হাদীছটিতে বর্ণিত হয়েছেমোটকথা এখানে পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সঙ্গে উক্ত হাদীছটি পুরোপুরিভাবে সঙ্গতিপূর্ণ এবং উভয়ের মূল্যায়ন এক ও অভিন্ন।
ক্বিয়ামতের উপরোক্ত বিবরণ পড়ে আমাদের উচিত এখনই সাবধান হওয়া। সেই দিনের জন্য যথাসাধ্য প্রস্ত্ততি নেওয়া। যাতে ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে আমরা নাজাত লাভ করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!