চিত্রশিল্পী: হেনরি রুশো (১৮৪৪-১৯১০),ফ্রান্স
ব্রাজিলের
ঘন বনাঞ্চলে যে বৃক্ষগুলো পাহাড়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে বৃক্ষগুলোর
স্থানীয় নাম ‘মাফুমেইরা’। বিশালাকার মাফুমেইরা নিয়ে বনের অধিবাসীদের মধ্যে নানা গল্প টিকে আছে
হাজার বছর ধরে।
অনেকেই মনে করেন মাফুমেইরা বৃক্ষগুলো
একটি পবিত্র শক্তির ধারক, যে শক্তি সব রকমের
অনিষ্টের হাত থেকে এ জঙ্গলকে বাঁচিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। স্বভাবতই এ মাফুমেইরা
বৃক্ষগুলো বনের অধিবাসীদের ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকে সর্বদা।
মাফুমেইরারা বনকে রক্ষা করে বিধায় বনের অনিষ্ট সাধন চিরস্থায়ীভাবে কখনো বন্ধ হয়ে
যায়নি। নানা সময়ে লোভী মানুষেরা বনকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে।
অডাও এবং তার দুই বন্ধু জঙ্গলের পাশের
একটি গ্রামে বাস করত। একদিন তারা তিন বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলো এখন থেকে তারা জঙ্গলে
গাছ কেটে জীবিকা নির্বাহ করবে। পরদিনই তারা তিনটি কুঠার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
নিয়ে বনের গভীরে চলে গেল। বনের গভীরে গিয়ে তারা প্রতিদিন কিছু গাছ কেটে গাছের গুড়ি
বানিয়ে গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি শুরু করল।
গ্রামবাসীরা তাদের থেকে গাছের গুড়ি
কিনে কেউ ঘর বানাত, কেউবা রান্না করার
লাকড়ি। এভাবে অডাও এবং তার বন্ধুদের ভালই কেটে যাচ্ছিল। তারা জঙ্গলের মধ্যে একটি
কুটির বানিয়ে নিয়ে বসবাসেরও ব্যবস্থা করল। একটি গাছ কেটেই তারা প্রচুর কাঠ পায়,
সেই কাঠ দিয়ে তারা সৎভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
তারা যখন একটি গাছ কাটত তার বিনিময়ে দুটি চারাগাছ রোপন করত জঙ্গলে,
যেন এ বনাঞ্চল বৃক্ষশূন্য না হয়ে পড়ে। প্রতিটি চারাগাছ রোপনের
সময় অডাও বলত, ‘যদি আমরা জঙ্গলের যত্ন নিই, তবে জঙ্গলও আমাদের যত্ন নেবে’।
অডাও ও তারা বন্ধুরা তাদের জীবন নিয়ে,
তাদের শ্রম নিয়ে, বাসস্থান নিয়ে পরিতৃপ্ত
ছিল। তারা প্রত্যেক মাসে একটি মাফুমেইরা বৃক্ষ কাটত এবং তার প্রতি সম্মানস্বরূপ
একটি চারাগাছ রোপন করত। কিন্তু তাদের এ আত্মতৃপ্তি দীর্ঘস্থায়ী হলো না। অডাও এর
অপর দুই বন্ধু তাকে না জানিয়ে অন্যরকম একটি সিদ্ধান্ত নিল। তারা দুজন ভেবে দেখল
তারা যদি মাসে অনেকগুলো মাফুমেইরা বৃক্ষ কাটতে পারে তবে তাদের অনেক সম্পদ হবে।
তারা খুব দ্রুত ধনী হয়ে যাবে, তখন তাদের আর কষ্ট করে গাছ
কাটতে হবে না।
অডাও যখন তাদের এ সিদ্ধান্ত জানতে
পারলো সে খুব কষ্ট পেল। সে তার বন্ধুদের প্রযোজনের অতিরিক্ত গাছ কাটতে নিষেধ করল।
কিন্তু তার লোভী বন্ধুরা তার কথাকে সম্মান করল না। তারা শহর থেকে ট্রাকটর এবং করাত
নিয়ে আসল। তারা করাত দিয়ে গাছের পর গাছ কাটতে লাগলো,এ বুঝি জঙ্গল উজাড় হওয়ার সূচনা। তারপর ট্রাকটরে করে একসঙ্গে অনেক গাছের
টুকরো শহরে গিয়ে বিক্রি করা শুরু করল। জঙ্গলের প্রতি তাদের আর কোনো মায়া-মমতাই
থাকল না। তারা আর কোনো নতুন চারাও লাগায় না।
তারা খুব দ্রুত মাফুমেইরা বৃক্ষ
কাটায়ও পারদর্শী হয়ে উঠল। তারা এতো দ্রুত গাছ কাটতে লাগলো যে অডাও নতুন করে চারা
লাগাতে পারছে না। অডাও যদিও বুঝতে পারল তার বন্ধুরা লোভের বশবর্তী হয়ে এমন করছে,
কিন্তু সে কিছুতেই থামাতে পারল না তার বন্ধুদের। তার বন্ধুরা
শিঘ্রই কোনো বড় বিপদ ডেকে আনবে। মাফুমেইরা জঙ্গলের এ অনিষ্ট কিছুতেই সহ্য করবে না।
অডাও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করল
সে একা এ জঙ্গলকে কিছুতেই অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু অডাও
জানতো না সে একা নয়, তার সঙ্গে আছে
জঙ্গলের পবিত্র শক্তি ‘মাফুমেইরা’। মাফুমেইরার পবিত্র শক্তি জঙ্গলের এ অসম্মান দেখে জেগে উঠল এবং
প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলো।
সেদিন রাতে অডাও কুটিরের ভেতর শুয়ে
আছে, সে বুঝতে পারলো সারা জঙ্গলে মাফুমেইরার
শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। জঙ্গলের চারদিকে অদ্ভুতগর্জন ভেসে আসছে। অডাও শুনতে পেল- ‘আমি মাফুমেইরার পবিত্র শক্তি, আমি জঙ্গলকে
রক্ষা করতে এসেছি, জঙ্গলকে অসম্মান করে কেউ বাঁচতে পারবে
না। জঙ্গলের প্রাণী ও বৃক্ষদের আমি বাঁচাবই।’ অডাও তার বন্ধুদের
অপরিনামদর্শী কাজের জন্য ভয় পেল। তারা এমনকি সেও হয়তো মাফুমেইরার শক্তির রোষ থেকে
বাঁচতে পারবে না। তার বন্ধুদের কৃতকর্মের জন্য তাকেও শাস্তি পেতে হবে।
পরদিন সকাল থেকে অডাওয়ের বন্ধুদের
পরিকল্পনামতো আর কিছু চলছিল না। তার দুই বন্ধুরই ঘুম ভাঙল পেটে অসম্ভব ব্যাথা
নিয়ে। কিন্তু পেটেরব্যাথাও তাদের লোভের কাছে অসহায়, অসুস্থ শরীর নিয়ে তারা গাছ কাটার যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ট্রাকটরে
উঠে দেখে ট্র্যাকটর কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না। একজন বলল, ‘ট্র্যাকটর নষ্ট হয়েছে, কোনো ব্যাপার না,
আমরা ট্রাকটর ছাড়াই অনেক কাঠ বইতে পারব। আরেকজন বলল, ‘পেটে ব্যাথা আমার কোনো সমস্যাই করতে পারবে না।’
যেই না তারা কুঠার উঠিয়ে গাছ
মাফুমেইরা গাছের দিকে কোপ দিতে গেল, অডাও তাদের থামল। অডাও তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে মিনতি করে বলল,‘বন্ধুরা তোমরা আজকের দিনটা অন্তত কোনো গাছ কেটো না, তোমরা বরং গাছের চারা রোপন করে আজকের দিনটা কাটাও, তোমাদের শরীরও আজ ভাল নেই।’
লোভী বন্ধুরা তার নিষেধ কিছুতেই শুনল
না। তারা যেই না মাফুমেইরার দিকে কুঠার উঠাল সেই না জঙ্গলে শুরু হল তুমুল ঝড়।
মাফুমেইরার ডালে ডাল লেগে বিকট শব্দ হলো, কেঁপে উঠল পুরো জঙ্গল, গর্জন করতে লাগলো
মাফুমেইরার শক্তি। সঙ্গে সঙ্গে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। ঝড় এবং বৃষ্টি তাদের
ঘরখানি উড়িয়ে নিয়ে গেল, এক বন্ধু আতঙ্কে হাত থেকে কুঠার
ফেলে হাত কেটে ফেলল। বৃষ্টিতে তাদের সমস্ত যন্ত্রপাতি ভেসে নদীতে তলিয়ে গেল। শুধু
ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কিছু তক্তা পড়ে রইল।
তখন অডাওয়ের এক বন্ধু চিৎকার
করে বলল, ‘আমাদের এখনই
পালাতে হবে, আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট এখানে নেই। তারপর
তারা জোরে দৌড়াতে লাগলো গ্রামের দিকে। অনেক কষ্টে তারা কোনো প্রকারে জীবন বাঁচিয়ে
বের হল জঙ্গল থেকে।
বাকি জীবনে তাদের আর কখনো জঙ্গলের
আশপাশে দেখা যায়নি। ভয় পেলেও অডাও জঙ্গল থেকে পালালো না,
সে ঝড়ো বাতাস সহ্য করতে লাগলো, বৃষ্টিতে
ভিজতে লাগলো। অডাও চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘আমি কখনো জঙ্গল ত্যাগ করব না, আমি বাকি জীবন
জঙ্গলে অসংখ্য চারা গাছ লাগাব, আমার বন্ধুরা যত গাছ
কেটেছে আমি তার থেকে বেশি গাছ লাগাব। আমি ততদিন চারাগাছ লাগাব যতদিন আমি বেঁচে
থাকব, কেউ আমাকে আমার কর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পাবে না।
আকস্মিক বৃষ্টি থেমে গেল,
ঝড়ো হাওয়া বন্ধ হয়ে গেল এবং আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। মিষ্টি রোদ
জঙ্গলের ভেজা মাটি শুকিয়ে দিল। অডাও সারাদিন গাছের চারা রোপন করতে লাগলো। একটার পর
একটা গাছ লাগাচ্ছে সে। এক সময় তার ক্ষুধা লাগলো, কিন্তু
সে থামলো না। এভাবে দিনের শেষে সে গাছ লাগাতে লাগাতে একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল। সে
চিন্তা করল- ‘হায় আমি কোথায় থাকব, আমার সব কিছুতো ঝড়ে ভেসে গেছে।’
তবুও সে তার কুটির যেদিকে ছিল সেদিকে
যেতে লাগলো। যখন সে তার কুটিরের কাছে ফিরে আসলো আশ্চর্য হয়ে দেখল,
তার কুটিরটি আগের মতোই আছে। অডাও আরও অবাক হলো যখন দেখল তার জন্য
টেবিলে সুন্দর করে খাবার সাজানো আছে এবং উষ্ণতার জন্য উনুনে মিটমিট করে হালকা আগুন
জ্বলছে।
অডাও বুঝল মাফুমেইরার মহাশক্তি তার
কুটির তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, সে শক্তিই ঝড়
সৃষ্টি করে জঙ্গলকে তার লোভী বন্ধুদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। সে টেবিলের খাবার পরম
তৃপ্তিতে গ্রহণ করল। কৃতজ্ঞতায় তার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ল। তাৎক্ষণিক
সে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করল- বাকিজীবন সে গাছের চারা রোপন করে কাটিয়ে দেবে। শুধু তার
মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য মাসে একটি মাফুমেইরা বৃক্ষ কাটবে।
অডাও ঠিক সে কাজটিই করে গেছে বাকি
জীবন। শোনা যায় অডাও জঙ্গলে আরও একশ বছর বেঁচেছিল। তারপর সে যখন শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করে তখন তার নিঃশ্বাস মাফুমেইরার মহাশক্তির সঙ্গে মিশে যায়। তখন থেকে জঙ্গলে
যারা মারা যায় তাদের আত্মা মাফুমেইরার মহাশক্তিতে বিলীন হয়ে যায়। এভাবে মাফুমেইরার
মহাশক্তি হাজার বছর ধরে জঙ্গলকে রক্ষা করে সব প্রকার অনিষ্ট থেকে।
গল্পটি ব্রাজিলিয়ান লোকগল্প ‘দ্য লিজেন্ড অব দ্য মাফুমেইরা’ অবলম্বনে রচিত