২০০
বছরে তৈরি পুড়ে শেষ কয়েক মিনিটে
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ
ও বহুল পরিচিত গির্জা নটর ডেম ক্যাথেড্রাল। প্যারিসের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শনও এটি। প্রাচীন এই গির্জাটিতে সোমবার স্থানীয়
সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আগুন লাগে এবং দ্রুত ছাদ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। সেই
আগুনে মূল কাঠামো আর দুটি বেলটাওয়ার বাদে মাত্র কয়েক মিনিটেই গির্জার অনেকাংশ
ধ্বংস হয়ে গেছে। চার্চটির ভিতরে ছিল বিপুল পরিমাণের কাঠের ফার্নিচার আর
নির্মাণসামগ্রী। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সেগুলোকেই দায়ী করা হচ্ছে।
নটর ডেমের মতো অন্য কোনো নিদর্শন বা জায়গা ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
জাতীয় প্রতীক হিসেবে এর কাছাকাছি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরা হয় আইফেল টাওয়ারকে। আর
তাই নটর ডেম ক্যাথেড্রাল অগ্নিকাণ্ডকে সে দেশের ভয়াবহ ‘ট্র্যাজেডি’
হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮২ বছর ধরে নির্মাণকাজ চলার পর ১২৪০
সালে শেষ হয়। তখন থেকে প্যারিসে দাঁড়িয়ে ছিল এই নটর ডেম। প্রায় ৮৫০ বছরের বেশি
পুরনো গির্জাটি ছিল সে সময়কার শক্তিশালী চার্চ। এখানে ফ্রেঞ্চ রাজাদের রাজ্যাভিষেক
হতো। চার্চের পোপই প্রথম কোনো রাজাকে মুকুট পরিয়ে দিতেন। রাজারাও হাঁটু গেড়ে
রাজমুকুট পরতেন। ইউরোপে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী
পর্যন্ত সময়টা ছিল গোথিক শিল্পের। নটর ডেম ক্যাথেড্রালকে ভাবা হয় ফরাসি গোথিক স্থাপত্যের
প্রাচুর্য। প্রতি বছর ১
কোটি ২০ লাখ পর্যটক ও তীর্থযাত্রী এই গির্জা দেখতে আসেন। শত শত
বছরের বৈচিত্র্যময় হস্তনির্মিত বস্তু, চিত্রকর্ম ও স্মৃতিচিহ্ন
সংরক্ষণ করা হয় গির্জায়। ১৫ এপ্রিল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে নটর ডেম
ক্যাথেড্রাল এখন আলোচনার কেন্দ্রে। এ ঘটনায় পর্যটকদেরও উৎকণ্ঠার
শেষ নেই।
ভ্রমণ বিষয়ক অস্ট্রেলীয় গাইড বুক
লোনলি প্লানেট জানিয়েছে, নটর ডেম ক্যাথেড্রালে
একসঙ্গে ছয় হাজারেরও বেশি ধর্মানুরাগী সমবেত হতে পারেন। নটর ডেম ক্যাথেড্রালেই
ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ হেনরির মাথায় ওঠে ফ্রান্সের রাজারমুকুট। পোপ পাইয়াস সপ্তমের
হাত ধরে ফ্রান্সের রাজা হিসেবে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অভিষেক হয়েছিল এই গির্জায়। উনিশ শতকে সংস্কারের
সময় গির্জার উপরিভাগে যুক্ত করা হয় পিরামিড। ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ভিক্টর হুগোর ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটর ডেম’ উপন্যাসের
সাফল্যের সুবাদে সংস্কারের উদ্যোগ আংশিকভাবে লাভবান হয়। গির্জার মূল তিনটি দরজায়
নানা নকশা করা সুবিশাল কাচের গোলাকার আকৃতি (রোজ উইন্ডোজ) ও অন্যান্য অসাধারণ
স্থাপত্যের জন্য গির্জাটি সুপরিচিত। ফরাসি বিপ্লব চলাকালেও নটর ডেম ভয়াবহভাবে
ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু উনিশ শতকে ফরাসি স্থপতি ইউজিন ভিওলেত- লে-দ্যুক এটি
পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে নেন। নটর ডেম ক্যাথেড্রালের ভাণ্ডারে হস্তনির্মিত
খ্রিস্টানদের পবিত্র কিছু নিদর্শন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রুশবিদ্ধকরণের সময়
যিশুর মাথায় থাকা ‘ক্রাউন অব থর্নস’। তাকে যেখানে বেঁধে ক্রুশবিদ্ধ করা হয় সেই ট্রু ক্রসের খণ্ড আর পেরেকও
রাখা ছিল। তবে প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো নিশ্চিত করেছেন,আগুন ধরার পর ক্রাউন অব থর্নস ও সেন্ট লুইয়ের পোশাকসহ অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ জিনিস উদ্ধার করা হয়েছে।
গির্জার বহির্ভাগের দেয়াল শক্ত রাখতে
প্রাণীর ভাস্কর্য ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক সমাধিকক্ষ রয়েছে গির্জার আঙিনার নিচে। উনিশ
শতকের ধ্বংসাবশেষ রক্ষার জন্য এটি তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে গির্জায় সংস্কারের কাজ চলছিল।
এজন্য সামনের অংশ থেকে বেশকিছু মূর্তি সরিয়ে রাখা হয়।
আগুনে পোড়া ব্রাজিলের
ইতিহাস রিও ডি জেনিরো
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর জাতীয়
জাদুঘর দেশটির সবচেয়ে পুরনো একটি বৈজ্ঞানিক ইনস্টিটিউট। জাদুঘরটি নগরীতে দাঁড়িয়ে
ছিল প্রায় দুইশত বছর ধরে। এই জাদুঘরে রাখা ছিল দুই কোটির বেশি নিদর্শন। ২০১৮ সালের
২ সেপ্টেম্বর জাদুঘরটি বন্ধ করার পর আকস্মিক আগুন লেগে যায়। আর এতেই ধ্বংস হয়ে যায়
ব্রাজিলের শত বছরের ইতিহাস। এর কিছুদিন আগেই এটি দুইশ বছর পূর্তি উদযাপন করে।
জাদুঘরে আগুন লাগার পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট মাইকেল তেমার বলেন,ব্রাজিলিয়ানদের জন্য এটি দুঃখের দিন,কারণ
দুইশ বছরের কর্ম, গবেষণা ও জ্ঞান নষ্ট হয়ে
গেছে। জাদুঘরের পরিচালক বলেন,এটি
কালচারাল (সাংস্কৃতিক) ট্র্যাজেডি।
জাদুঘরের ওয়েবসাইট অনুযায়ী এতে
ব্রাজিলের ইতিহাস সম্পর্কিত হাজার হাজার তথ্য, নিদর্শন এবং মিসরের শিল্পকর্মের অনেক নিদর্শন ছিল। এছাড়া ডাইনোসরের গুরুত্বপূর্ণ
কঙ্কাল এবং ১২ হাজার বছর আগের এক নারীর কঙ্কাল- আমেরিকা মহাদেশে প্রাপ্ত সবচেয়ে
পুরনো নিদর্শন ছিল। এছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকার শিল্পকর্মের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক
নিদর্শন, জীবাশ্ম ও উল্কাপিণ্ড রাখা ছিল। রাজকীয় জাদুঘর
হিসেবে ১৮১৮ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষজ্ঞদের
জন্য বিশাল সংগ্রহশালার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সহজতর করা। শেষ সময়ে
মিউজিয়ামের দেখভালের দায়িত্বে ছিল যৌথভাবে রিও ডি জেনিরো ফেডারেল ইউনিভার্সিটি এবং
ব্রাজিলের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেশ কিছুদিন ধরে রিও ডি জেনিরো একটি সংকটের মধ্যে
যাচ্ছিল। সম্প্রতি ব্রাজিলে বৃদ্ধি পায় সহিংসতা ও অর্থনৈতিক মন্দা। কমে যায়
পর্যটকের সংখ্যা। আর রাজনৈতিক পর্যায়ে দুর্নীতি তো ছিলই। এসব মিলে শহরটির ওপর এক
কালো প্রভাব পড়ে। এমন অবস্থায় জাদুঘরটির প্রতি কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিন নজর ছিল না।
এমন কি এ খাতে অর্থায়ন হয়েছে সামান্যই। শেষমেশ ভয়াবহ আগুনে ধ্বংস হলো জাদুঘরটি।
নিমিষেই শেষ হয়ে গেল ব্রাজিলের ২০০ বছরের কাজ, গবেষণা ও
স্বীকৃতি।
তালেবান লুট করে আফগান
জাদুঘর
১৯১৯ সালে রাজা আমানউল্লাহ খানের
শাসনামলে নির্মাণ হয় আফগান জাতীয় জাদুঘর। মধ্য এশিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জাদুঘর ছিল এটি। ২০১৪ সালের হিসাব
অনুযায়ী, জাদুঘরটি
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বিস্তৃতি লাভ করে। আগত দর্শনার্থীরা আরাম-আয়েশ করে
জাদুঘরের সুবিশাল উদ্যানে ঘুরে বেড়াতেন। সেখানে ১ লাখের বেশি স্বতন্ত্র বস্তু সুশৃঙ্খলভাবে
সাজানো ছিল। ১৯৯২ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে এই জাদুঘরে বহুবার লুটপাট
করা হয়েছিল। যার ফলে প্রদর্শনীর সব বস্তুর ওপর প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষতিসাধন হয়েছিল।
১৯৯৩ সালে রকেট হামলা করে জাদুঘরটি খুলে লুট করা হয়। বেশির ভাগ দুর্লভ দ্রব্য
পাকিস্তান হয়ে চলে যায় অন্য দেশে। অন্য দেশের ধনী সংগ্রাহকদের কাছে সেগুলো বিক্রি
করা হয়। আফগান প্রাচীন নিদর্শনের এসব অবৈধ ড্রাগসের ব্যবসার পরই সবচেয়ে বেশি
অর্থের ব্যবসা ছিল। ২০০০ সালে তালেবান পুলিশ জাদুঘরের অবশিষ্ট ২৭০০ শিল্পকর্ম,
যাদের মধ্যে অনেক প্রাচীন সাংস্কৃতিক সম্পদ ছিল, মূর্তিপূজা আখ্যা দিয়ে ইসলামের নামে ধ্বংস করে ফেলে। তালেবানের পতনের
আগে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে আরেক দফা লুটতরাজ ঘটে। ২০০৭ সাল থেকে বেশ কয়েকটি
আন্তর্জাতিক সংস্থা ৮ হাজারের ওপরে জিনিসপত্র উদ্ধার করতে সাহায্য করে।
মন্ট্রিল পার্লামেন্টে
বার বার আগুন
প্রাক-কনফেডারেশন কানাডিয়ান ইতিহাসে
মন্ট্রিলের সংসদ ভবন পুড়ে যাওয়া একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। অগ্নিকাণ্ডটি ঘটেছিল ১৮৪৯
সালের ২৫ এপ্রিল রাতে। সে সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কানাডায় গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত
আগ্রহের কারণে রাজনৈতিক সংস্কারগুলোতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮৩৭-৩৮ সালে কানাডীয়রা
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অলৌকিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো নিম্ন কানাডায়
এবং তারপর উচ্চ কানাডা (ক্যুবেক ও অন্টারিওর কানাডিয়ান প্রদেশ) বিদ্রোহ করেছিল। ফলস্বরূপ
ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় পার্লামেন্ট ভবন। সেদিনের আগুনে ভবনটি পুরোপুরি পুড়ে যায়। এরমধ্যে
ছিল পার্লামেন্টের দুটি লাইব্রেরি, উচ্চ কানাডা ও লোয়ার কানাডার আর্কাইভের অংশ ও সাম্প্রতিক জনসাধারণের
ডকুমেন্টস। এই লাইব্রেরিতে ২৩ হাজারেরও বেশি ভলিউম সংসদীয় গ্রন্থাগারের সংগ্রহে
ছিল। কেবলমাত্র ২০০ বই আর রানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছিল।
১৮৪৫ সাল থেকে আর্কাইভটি গঠন করা হচ্ছিল। ভবনটি ধ্বংস হওয়ার দুই বছর পরই আবার নতুন
করে গঠন করা হয়। সেখানে দুটি লাইব্রেরিও সাজানো হয় প্রায় সাড়ে ৪ হাজার নতুন বই দিয়ে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ১৮৫৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অগ্নিকাণ্ডে কানাডাকে পার্লামেন্ট
ভবনটি পুরোটাই হারাতে হয়।
আইএসের হাতে ধ্বংস
স্থাপনা
মসুল জাদুঘর
হাজার বছর আগে ইরাকের মেসোপটেমিয়া
থেকে শুরু করে অসিরীয়,ব্যাবিলন ও অটোমান সভ্যতার
পদচারণা ঘটেছিল। সে সব সভ্যতার বহু নিদর্শন মানুষকে অতীতের সেই স্বর্ণযুগ সম্পর্কে
ধারণা দিত। কিন্তু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস মেতে উঠে ঐতিহ্য ধ্বংসের লীলাখেলায়। খুব
অল্প সময়ে আইএস ইরাকের মসুল দখল করে নেয়। দখল করার পর থেকেই সেখানে চলে ইতিহাসের
ভয়ঙ্কর ও জঘন্যতম ধ্বংসলীলা। লুটপাট চলে জাদুঘরের মূল্যবান সব ঐতিহ্যকে ঘিরে।
ধ্বংস করা হয় পাথরের তৈরি সব ভাস্কর্য ও মূর্তি। বহু পুরাকীর্তি দেশের বাইরে
বিক্রিও করে ওই জঙ্গিরা।
জাদুঘরে হওয়া বিস্ফোরণে মেঝে ছিদ্র
হয়ে যায়, দরজা ভেঙে ফেলা হয়,
ঘরে কোনো বস্তুই অক্ষত থাকে না। পুরাকীর্তি সাজিয়ে রাখার তাকগুলো
সব খালি হয়ে যায়। ওই জাদুঘর দখল করাটা ছিল আইএসের প্রতীকী বিজয়। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে
এক ভিডিওতে
দেখা যায়, সেখানকার অত্যন্ত সমৃদ্ধ এই
জাদুঘরটিতে হাতুড়ি নিয়ে অমূল্য শিল্পকর্মগুলোকে এলোপাতাড়ি আঘাতে ভাঙছে আইএস
সদস্যরা। অসিরীয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রচলিত হস্তনির্মিত শিল্পগুলো ধ্বংস করে ফেলা
হয়। যার বেশির ভাগই আনা হয়েছিল প্রাচীন শহর হাতরা থেকে। নিনেভের নের্গলের গেটের
মূল্যবান গ্রানাইট পাথরের তৈরি লামাসুও ছিল সেখানে। ১৯৪০ সালে আবিষ্কারের পর মসুল
জাদুঘরে এটি সংরক্ষিত ছিল। ইরাকের জাতীয় জাদুঘরের বরাত দিয়ে জানানো হয়, ইসলামবিরোধী যুক্তি দেখিয়ে জঙ্গিরা মসুলের জাদুঘরের মূর্তি ভাঙার সঙ্গে
সঙ্গে পুড়িয়ে দেয় বহু প্রাচীন পুঁথিপত্র। বেশকিছু প্রাচীন মূর্তির ছাঁচে তৈরি
প্লাস্টার অব প্যারিসের মূর্তি ছিল ঠিকই। সেই সঙ্গে সেখানে ব্যাবিলন ও অসিরীয়
সভ্যতার নিদর্শনও সংরক্ষিত ছিল। ইরাকের সরকারি কর্মকর্তা জানান, শহরটির প্রাচীন ইতিহাস কার্যত মুছে দেওয়া হয়। বেশির ভাগ হস্তশিল্পের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাগদাদ জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে। ৩০০টি
গুরুত্বপূর্ণ মূর্তি ও ভাস্কর্য ধ্বংস করেছে আইএস। যার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো।
মসুল কেন্দ্রীয়
গ্রন্থাগার
২০১৪ সালের জুনে ইসলামী স্টেট মসুলসহ
আশপাশের এলাকা দখল করে। সে সময় তারা মসুল কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি বন্ধ করে দেয়।
কথিত ইসলামী বিশ্ব কায়েমে আইএস তাদের অভিযান চালিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনার
ওপর। মসুল জাদুঘরের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
তারা মসুল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ইসলামবিরোধী ও নাস্তিকবাদী
আখ্যা দিয়ে লুটপাট করে গ্রন্থাগারের মূল্যবান বই। ভাঙচুর করে গ্রন্থাগারের
পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন ল্যাবরেটরি। পুড়িয়ে দেয় ১০ হাজারেরও বেশি বই। যার মধ্যে
প্রায় ৮ হাজারেরও বেশি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি ছিল।
গ্রন্থাগারে ৭ হাজার বছরের
বেশি পুরনো পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও
সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর ভাষায়, এ হামলা মানব ইতিহাসে
গ্রন্থাগার ধ্বংসের সবচেয়ে জঘন্য হামলা। তবে সে সময় মসুলের কয়েকজন ধনাঢ্য লুট হওয়া
কিছু পাণ্ডুলিপি কিনে সংরক্ষণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য পুরনো ঐতিহ্যে প্রতিস্থাপন।
ধ্বংসযজ্ঞ চলার সময় কিছু বয়স্ক ব্যক্তি গ্রন্থাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে বহু মিনতি
করেন। কিন্তু জঙ্গিরা তাতে কর্ণপাত করেনি। সে সময় এক জঙ্গি বলে,এসব বই নাস্তিকদের প্রচার এবং ইসলামবিরোধী, তাই
এগুলো পুড়িয়ে
দেব। ধ্বংস হওয়া গ্রন্থাগারের এসব মূল্যবান বই ও পাণ্ডুলিপি ইতিহাস
থেকে হারিয়ে গেছে। যা আর কোনো দিনও ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। এ এক অপূরণীয়
ক্ষতি।
মায়া সভ্যতার শেষ
পিরামিড ধ্বংস
২৩০০ বছরের পুরনো মায়া সভ্যতা। ২০১৩
সাল পর্যন্ত মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজে টিকে ছিল মায়া সভ্যতার সময় নির্মিত সবচেয়ে
বড় পিরামিডগুলোর একটি ‘নোহ মূল টেম্পল’। কিন্তু একটি সড়ক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজের জন্য নুড়িপাথর সংগ্রহ
করতে পিরামিডটি ধ্বংস করে। প্রাচীন সভ্যতা কেউ এভাবে ধ্বংস করতে পারে ভেবে বিস্ময়
প্রকাশ করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। সড়ক নির্মাণের জন্য সেখানে অহরহই মায়া সভ্যতার
পিরামিডগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। মায়া সভ্যতার অনেক কীর্তিই ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমির
ওপর দাঁড়িয়ে। তবে বেলিজের আইন অনুযায়ী তা সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের। এখন সেখানে
টিকে আছে মায়া সভ্যতার ছোট ছোট মাত্র কয়েকটি পিরামিড। মায়া সভ্যতার এই পিরামিডগুলো
মিসরের পিরামিডের মতো নয়। মায়ান পিরামিডের ওপরে মনে হবে একটি বিশাল চৌকো ঘর বসানো
হয়েছে। একই সঙ্গে চমৎকার বাঁধানো সিঁড়ি আছে চারপাশে। পিরামিডটি মোট নয় ধাপের। প্রতিটি
ধাপ সিঁড়ি দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা অর্থাৎ মোট ১৮ ধাপ। এটি মায়ান বর্ষপঞ্জির ২০ দিনের মাসের হিসাবে ১৮
মাসের প্রতীক। প্রতিটি সিঁড়ির ৯১টি ধাপ রয়েছে। চারদিকের সিঁড়ির সঙ্গে ওপরের কক্ষ
যোগ করলে ৩৬৫ হবে, অর্থাৎ
এক বছরের হিসাব। এছাড়া প্রতি ধাপে ৫২টি প্রস্তরখণ্ড যা ৫২ সপ্তাহের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বোমায় উড়ে যায় প্রাচীন
দুর্গ
অটোমান সাম্রাজ্যের সময়কার প্রাচীন
দুর্গ তাল আফার। ইরাক যুদ্ধে ২০০৫-এ দুর্গটি ন্যাটো বাহিনী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার
করে। আমেরিকান সৈন্যরা এই দুর্গ থেকে অনেক অপারেশন সম্পন্ন করে। এটি শহরের পৌরসভা
এবং পুলিশ সদর দফতর হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল। ২০১৪ সালে এর প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়।
ইসলামিক স্টেট দুর্গটি দখল করে। দুর্গটি সে সময় অনৈতিক কাজে ব্যবহার করত। মূলত এটি
ছিল মহিলাদের জেলখানা। জঙ্গিরা ইরাকি মহিলাদের জোরপূর্বক বিয়ে করে এখানে আটকে রাখত।
যারা বিয়েতে রাজি হতো না তাদের ওপর নেমে আসত অমানবিক নির্যাতন। ইরাকের সরকারি
হিসাব অনুযায়ী দুর্গটির বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করা হয়। ২০১৪-এর ৩১
ডিসেম্বর আইএস দুর্গটি গুঁড়িয়ে দেয়। দুর্গটির উত্তর এবং পশ্চিম
দেয়াল বোমার আঘাতে উড়ে যায়। এছাড়া জঙ্গিরা দুর্গের বিভিন্ন অংশ খনন
করে। নষ্ট করা হয় অটোমান সময়ের বহু নিদর্শন। সম্ভবত জঙ্গিরা এই হস্তনির্মিত
নিদর্শনগুলো বিক্রি করে ফেলে কিংবা
পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। আইএস তাল আফার শহরের দুর্গটি তো বটেই, ৩০টি মঠ এবং ১৫টি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়।
মিলিয়ে গেছে হরপ্পা সভ্যতা
দীর্ঘ ৬০০ বছর গৌরবের সঙ্গে টিকে
থাকার পর ১৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিন্ধু ও তার পার্শ্ববর্তী শহরগুলো অদৃশ্য হয়ে
যায়। এগুলো ছিল হরপ্পা সভ্যতার প্রধান দুটি কেন্দ্র হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো। সভ্যতা
দুটি কালের গর্ভে মিলিয়ে যেতেও সময় নেয় প্রায় ১০০ বছর। অনেকের মতে ভূমিকম্পের
কারণে হরপ্পা ধ্বংস হয়েছিল। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত ক্ষত-বিক্ষত
কঙ্কালকে। ভূমিকম্পের কবলে পড়লেই এমনটি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের যুক্তি। অনেকে
অবশ্য হরপ্পা ধ্বংসের পেছনে হরপ্পার নাগরিকদের রক্ষণশীল মানসিকতা বা বন্ধ্যত্বকে দায়ী
করে। বিশেষজ্ঞদের মতে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে এই বন্ধ্যত্ব শুরু হয় মানসিক
দিক থেকে শেষমেশ গড়ায় অর্থনৈতিক বন্ধ্যত্বে। তারা ব্যাবিলন বা সুমেরু খালের পানি
দিয়ে চাষ করত। কিন্তু নিজেদের এলাকায় এই পদ্ধতি প্রয়োগের কোনো উদ্যোগ ছিল না।
অস্ত্র নির্মাণে আগ্রহ ছিল না। এসব কারণে তাদের পতন ঘটেছে বলে ধারণা ইতিহাসবিদদের।
গুঁড়িয়ে গেছে প্রাচীন
লামাসু
ইরাকের প্রাচীন অসিরীয় সাম্রাজ্যের
স্থাপনা ‘লামাসু’। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস
ধ্বংস করে ফেলেছে। ইরাকি প্রশাসন ও পশ্চিমা দুনিয়ার ওপর রাগ মেটাতে তাদের এই
ধ্বংসযজ্ঞ। প্রাচীন ভাস্কর্যগুলোর শরীর দেখতে সিংহ, ঘোড়া
বা ষাঁড়ের মতো,কিন্তু মুখটি মানুষের। দেখলেই মনে হবে
দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। লামাসুর ক্ষমতার ওপর সে সময়ের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর পাড়ের নগরীর বাসিন্দাদের ভরসা ছিল
অসীম। প্রাচীন যুগে লামাসুগুলোকে স্থানীয়রা দেবতা মনে করত। তখনকার প্রথা অনুযায়ী
নগর রক্ষায় প্রতিটি প্রবেশদ্বারে ‘লামাসু’ তৈরি করা হতো। অসিরীয় সাম্রাজ্যে রাজা-রানী এবং সাধারণ বাসিন্দারা কেউই
ভাবেনি নগরীর এই প্রাচীরগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। আইএস শুধু নিনেভা প্রাচীরই ধ্বংস
করেনি,হাজার বছরের অসিরীয় সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করেছে।
হাতুড়ি, শাবল এমনকি ড্রিল মেশিন ব্যবহার করে আইএস সদস্যরা
প্রাচীরটি ভেঙেছে। কিছু লামাসু বাইরের জাদুঘরে সরানো হয়েছে। তবে প্রায় ২৭
থেকে ৩০ টন ওজনের লামাসুগুলো জাদুঘরে সরানো যায়নি।
তানিয়া তুষ্টি
বাংলাদেশ প্রতিদিন
No comments:
Post a Comment