বিষুবরেখার অতি নিকটে তৈরি হওয়া এ সাইক্লোন ভূমিতে আছড়ে পড়ার
জন্য যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসছে,
তার ভিত্তিতেও ফণী অন্যরকম।
ফণীর সাম্প্রতিক গতিপথ
ওড়িশা উপকূলের দিকে ধেয়ে
যাচ্ছে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ফণী। শুক্রবার তা পুরীতে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা। মনে করা
হচ্ছে ২০০ কিলোমিটার বেগে ধাবমান এই ঝড় ওড়িশা ও সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে ব্যাপক
ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে। শেষবার এ ধরনের সাইক্লোন বঙ্গোপসাগরে দেখা গিয়েছিল ২০০৮
সালে। সেবার বহু মানুষ মারা গিয়েছিলেন মায়ানমারে। কিন্তু তার একটা বড় কারণ ছিল
আধুনিক বিপদসংকেত ব্যবস্থার অপ্রতুলতা। সেবার মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত
পরিকাঠামোও ছিল না।
অন্যদিকে ফণী সপ্তাহখানেক
আগে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণপূর্বে তৈরি হওয়ার সময়কাল থেকেই তার উপর নজরদারি চলছে।
কয়েকঘণ্টা অন্তর মৎস্যজীবী ও উপকূলবাসী মানুষদের
উদ্দেশে সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে এবং ব্যাপকহারে আপৎকালীন
ব্যবস্থাগ্রহণ চলছে। গত কয়েকবছরে ভারত সাইক্লোনজনিত বিপর্যয় মোকাবিলা করেছে খুব
ভালভাবে। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় ২০১৩ সালের ঘুর্ণিঝড় ফাইলিনের কথা। ফাইলিন আসন্ন
ফণীর থেকেও বেশি শক্তিশালী ছিল।
কীভাবে
হয় ঝড়ের নামকরণ? ‘ফণী’ নামটাই বা
কার দেওয়া?
পরবর্তী ঝড়ের নাম কী হবে?
ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে উদ্ভূত ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের
নামের তালিকা আঞ্চলিক কমিটির কাছে পাঠায় ভারত, শ্রীলঙ্কা,
বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান,
এবং থাইল্যান্ড।
ওড়িশায়
পুরী থেকে ১০ কিমি উত্তরে চন্দ্রভাগায় শুক্রবার দুপুরে মাটি ছোঁবে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’। সপ্তাহান্তে ঘন্টায় ২০০ কিমি পর্যন্ত
বেগে হাওয়া আঘাত হানতে পারে অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িশা এবং
পশ্চিমবঙ্গে। ‘অত্যন্ত তীব্র’ এই
ঘূর্ণিঝড় আপাতত ওড়িশায় ‘ল্যান্ড’ করেছে এবং দ্রুতবেগে পশ্চিমবঙ্গের দিকে ধেয়ে
আসছে বলে আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর।
অবশ্য
সাইক্লোন কোনও নতুন ব্যাপার নয় ওড়িশায়। এর আগে সবচেয়ে সাম্প্রতিক সাইক্লোন ছিল ‘তিতলি’, যা গত বছর ঘণ্টায় ১৮০ কিমি বেগে আছড়ে
পড়ে এই রাজ্যে, যার ফলে প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে নিরাপদ
স্থানে সরিয়ে নিয়ে যায় রাজ্য প্রশাসন। তা সত্ত্বেও ওড়িশায় ‘তিতলি’ কেড়ে নেয় অন্তত দু’টি প্রাণ।
ৎ সাপের সঙ্গে প্রাণনাশের
যথেষ্ট যোগ আছে। এক্ষেত্রে কোনও ব্যঙ্গ নেই।
প্রশ্ন
হলো,
কে বা কারা রাখে এসব নাম? তথ্য ঘাঁটলে
দেখা যায়, এই প্রথা চালু হয় অ্যাটল্যান্টিক মহাসাগরে
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে। যেসব ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৯ মাইল ছাড়িয়ে যেত, তাদের বিশেষ সম্মান জানাতে নামকরণ করা হতো। ঘণ্টায় হাওয়ার গতিবেগ ৭৪
মাইল ছাড়িয়ে গেলে হারিকেন, সাইক্লোন বা টাইফুন হিসেবে ভাগ করা হতো। বর্তমান যুগে এই তিনটির একটি হলে তবেই
কোনও ঝড়কে নামকরণের সম্মান প্রদান করা হয়।
আজকের দিনে ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের আনুষ্ঠানিক নামকরণ করে সারা বিশ্বে
ছড়িয়ে থাকা ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশনের আওতায় এগারোটি সতর্কতা
কেন্দ্রের যে কোনও একটি। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সব নাম জমা পড়ে এই সংস্থার
আঞ্চলিক ট্রপিক্যাল সাইক্লোন কমিটির কাছে। একবার নাম চূড়ান্ত হয়ে গেলে তা বদল করা
যায় না, যদি না ঝড়ের
ফলে খুব বেশি মাত্রায় মৃত্যু অথবা সম্পত্তি বিনষ্ট হয়।তাহলে ‘ফণী’ নামটা কে রেখেছে? উত্তর: বাংলাদেশ। এই নামকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করে দিল্লির রিজিওনাল
স্পেশালাইজড মিটিওরোলজিকাল
কেন্দ্র।
নামের তালিকা
ওয়ার্ল্ড
মিটিওরোলজিকাল অর্গানাইজেশন একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে যার দ্বারা বিভিন্ন দেশের
কাছ থেকে ঝড়ের নামের তালিকা গ্রহণ করে তারা। প্রয়োজন মতো এই সমস্ত তালিকা থেকে
বেছে নেওয়া হয় নাম। ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে উদ্ভূত ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের
নামের তালিকা আঞ্চলিক কমিটির কাছে পাঠায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার,
ওমান, পাকিস্তান, এবং থাইল্যান্ড।
বিগত
বেশ কয়েক বছর ধরে এই আটটি দেশের তরফে আটটি করে ভবিষ্যতের সাইক্লোনের নাম জমা করা
হয়েছে। সেই ৬৪ টি নামের তালিকা থেকেই বেছে নেওয়া হয়েছে ‘ফণী’, যেমন বেছে নেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের
দেওয়া নাম ‘তিতলি’, বা
মালদ্বীপের দেওয়া ‘আইলা’।
বর্তমানে এই তালিকার শেষ স্তম্ভ থেকে নাম বাছা হচ্ছে, ফলে
এই অঞ্চলে পরবর্তী সাইক্লোনের নাম হতে চলেছে ‘বায়ু’।
ভারতের পূর্বভাগে
সাইক্লোন নতুন কিছু নয়। গড় হিসেবে দেখতে গেলে পাঁচ থেকে ছটি বড়সড় ঘূর্ণিঝড়
প্রতি বছর বঙ্গোপসাগরে উদয় হয়। এপ্রিল ও মে মাসে, বর্ষা শুরুর ঠিক আগে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে,
বর্ষা শেষের ঠিক পরের সময়টাই সাইক্লোনের সময়।
তবু ফণী সামান্য হলেও অন্যদের
থেকে আলাদা। তার একটা বড় কারণ এর শক্তি এবং এর গতিপথ। এপ্রিল-মে মাসে যে সব
সাইক্লোন পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি
অক্টোবর-ডিসেম্বরের থেকে তুলনামূলকভাবে দুর্বল। বঙ্গোপসাগর এলাকায় ১৮৯১ সাল থেকে
হিসেব করলে এপ্রিল মাসে যে সব সাইক্লোন দেখা গেছে, তার
মধ্যে মাত্র ১৪টি অতি শক্তিশালী। এর মধ্যে মাত্র একটি ভারতীয় ভূমি স্পর্শ করেছিল।
সেটা ছিল ১৯৫৬ সালের ঘটনা। অন্য সমস্ত সাইক্লোনই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল বাংলাদেশ,
মায়ানমার অথবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্য দেশের দিকে। ১৯৯০ সাল
থেকে হিসেব করলে এপ্রিল মাসে এরকম মাত্র চারটি সাইক্লোন দেখা গেছে।
ফণী শুধু শক্তিশালী নয়, অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়। ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের
শক্তি পরিমাপ করা হয় তার কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ দিয়ে। শক্তির দিক থেকে একেবারে
নিচের দিকে যে সাইক্লোন তার ক্ষেত্রে বাতাসের গতিবেগ হয় ৩০ থেকে ৬০ কিলোমিটার,
এর ওপরেরটায় বাতাসের গতিবেগ থাকে ৬১-৮৮ কিলোমিটার, শক্তিশালী সাইক্লোনের ক্ষেত্রে বাতাসের গতিবেগ থাকে ৮৯ থেকে ১১৭
কিলোমিটার, অতি শক্তিশালী সাইক্লোনের ক্ষেত্রে বাতাসের
গতিবেগ থাকে ১১৮-১৬৬ কিলোমিটার। সুপার সাইক্লোনের ক্ষেত্রে বাতাসের গতিবেগ হয় ২২২
কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়।
বিষুবরেখার অতি নিকটে
তৈরি হওয়া এ সাইক্লোন ভূমিতে আছড়ে পড়ার জন্য যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে আসছে, তার ভিত্তিতেও ফণী অন্যরকম।
ফণী কীভাবে শক্তিবৃদ্ধি করে
বঙ্গোপসাগরে স্থানীয় ভাবে
তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় সাধারণ ভাবে তৈরি হয় ১০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে, চেন্নাই তিরুবনন্তপুরম রেখা ধরে। অন্যদিকে ফণী
তৈরি হয়েছে বিষুবরেখার খুব কাছে ২ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে। দীর্ঘ সমুদ্রপথ ভেদ করায়
শক্তি বাড়িয়েছে ফণী, যা এরকম মরশুমে বঙ্গোপসাগরে তৈরি
হওয়া সাইক্লোনের থেকে ধরন হিসেবেই আলাদা।
প্রাথমিকভাবে এর মুখ ছিল
উত্তরপশ্চিমে, তামিলনাড়ুর
উপকূলে। কিন্তু মধ্যপথে সে গতি পরিবর্তন করে, এবং মুখ
ঘোরায় ওড়িশা উপকূলের দিকে। এর ফলে সমুদ্রের ওপরে আরও সময় পেয়েছে এই সাইক্লোন।
আইআইটি ভুবনেশ্বরের
আবহাওয়াবিদ ইউসি মহান্তি বলেন, “যদি ফণী প্রাথমিক গতিপথে থাকতে এবং তামিলনাড়ু উপকূলে আছড়ে পড়ত,
তাহলে এ সাইক্লোন এখনকার মত এত দুরন্ত হত না। সমুদ্রে দীর্ঘতর
সময় কাটানোর ফলে এর শক্তি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে।”
No comments:
Post a Comment