Wednesday, March 27, 2019

খান জাহান আলী (র.)


মুসলিম ধর্ম প্রচারক

                                          হযরত খানজাহান আলি (র.) এর মাজার ভবন,বাগেরহাট

হযরত খানজাহান আলি (র.) (জন্ম ১৩৬৯-মৃত্যু অক্টোবর ২৫,১৪৫৯) ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক এবং বাংলাদেশের বাগেরহাটের স্থানীয় শাসক।তাঁর অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে উলুঘ খান,খান-ই-আজম ইত্যাদি।


                                                      খান জাহান আলির তৈরি ষাট গম্বুজ মসজিদ

হযরত উলুঘ খানজাহান আলি (র.) ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম আকবর খাঁ এবং মাতার নাম আম্বিয়া বিবি।ধারণা করা হয় যে তার পূর্বপুরুষগণ তুরস্কের অধিবাসী ছিলেন।খানজাহান আলির প্রাথমিক শিক্ষা তার পিতার কাছে শুরু হলেও তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন দিল্লিস্থ বিখ্যাত ওয়ালি এ কামিল পির শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে। তিনি কুরআন,হাদিস,সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের উপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন।
খানজাহান আলি ১৩৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সেনা বাহিনীতে সেনাপতির পদে কর্ম জীবন আরম্ভ করে। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন।১৩৯৪ এ মাত্র ২৬/২৭ বছর বয়সে তিনি জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্নর) পদে যোগ দেন।পরবর্তীতে সুলতান খানজাহানের নেতৃত্বে ৬০,০০০ সুশিক্ষিত অগ্রবর্তী সেনাদল সহ আরও দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলে রাজা গণেশ দিনাজপুরের ভাতুরিয়াতে আশ্রয় নেন।১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে খানজাহান যশোরের বারবাজারে অবস্থান নেন এবং বাংলার দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসার আরম্ভ করেন।
খানজাহানের প্রথম স্ত্রীর নাম সোনা বিবি।কথিত আছে সোনা বিবি ছিলেন খানজাহানের পির নুর-কুতুবুল আলমের একমাত্র কন্যা।খানজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী রূপা বিবি ওরফে বিবি বেগনি ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিলেন।খানজাহান আলি তাঁর দুই স্ত্রীর নাম অনুসারে সোনা মসজিদ এবং বিবি বেগনি মসজিদ নামে মসজিদ নির্মাণ করেন।

ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদমসজিদটির গায়ে কোনো শিলালিপি নেই।তাই এটি কে নির্মাণ করেছিলেন বা কোন সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল সে সম্বন্ধে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে এটি যে খান জাহান আলী নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকে না।ধারণা করা হয় তিনি ১৫শ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেন।এ মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল।পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে।এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটির মধ্যে অবস্থিত;বাগেরহাট শহরটিকেই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এই সম্মান প্রদান করে।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া।দেয়ালগুলো প্রায় ৮·৫ ফুট পুরু।

ইতিহাস

সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন।খানজাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন,যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হয়।এ মসজিদটি বহু বছর ধরে ও বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল।পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে।তুঘলকি ও জৌনপুরী নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট।

বহির্ভাগ

মসজিদটির পূর্ব দেয়ালে ১১টি বিরাট আকারের খিলানযুক্ত দরজা আছে।মাঝের দরজাটি অন্যগুলোর চেয়ে বড়।উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আছে ৭টি করে দরজা।মসজিদের ৪ কোণে ৪টি মিনার আছে।এগুলোর নকশা গোলাকার এবং এরা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে।এদের কার্ণিশের কাছে বলয়াকার ব্যান্ড ও চূঁড়ায় গোলাকার গম্বুজ আছে।মিনারগুলোর উচ্চতা,ছাদের কার্নিশের চেয়ে বেশি।সামনের দুটি মিনারে প্যাঁচানো সিঁড়ি আছে এবং এখান থেকে আজান দেবার ব্যবস্থা ছিল।এদের একটির নাম রওশন কোঠা,অপরটির নাম আন্ধার কোঠামসজিদের ভেতরে ৬০টি স্তম্ভ বা পিলার আছে।এগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণে ৬ সারিতে অবস্থিত এবং প্রত্যেক সারিতে ১০টি করে স্তম্ভ আছে।প্রতিটি স্তম্ভই পাথর কেটে বানানো,শুধু ৫টি স্তম্ভ বাইরে থেকে ইট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।এই ৬০টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের ওপর তৈরি করা হয়েছে গম্বুজ।মসজিদটির নাম ষাট গম্বুজ (৬০ গম্বুজ) মসজিদ হলেও এখানে গম্বুজ মোটেও ৬০টি নয়,বরং গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি।৭৭টি গম্বুজের মধ্যে ৭০ টির উপরিভাগ গোলাকার এবং পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজা ও পশ্চিম দেয়ালের মাঝের মিহরাবের মধ্যবর্তী সারিতে যে সাতটি গম্বুজ সেগুলো দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চৌচালা ঘরের চালের মতো।মিনারে গম্বুজের সংখ্যা ৪ টি-এ হিসেবে গম্বুজের সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ৮১ তে।তবুও এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ।ঐতিহাসিকরা মনে করেন,সাতটি সারিবদ্ধ গম্বুজ সারি আছে বলে এ মসজিদের সাত গম্বুজ এবং তা থেকে ষাটগম্বুজ নাম হয়েছে।আবার অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন,গম্বুজগুলো ৬০ টি প্রস্তরনির্মিত স্তম্ভের ওপর অবস্থিত বলেই নাম ষাটগম্বুজ হয়েছে।

অভ্যন্তরভাগ

মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে।মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং কারুকার্যমন্ডিত।এ মিহরাবের দক্ষিণে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে।শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে যেখানে ১টি মিহরাব থাকার কথা সেখানে আছে ১টি ছোট দরজা।কারো কারো মতে,খান-ই-জাহান এই মসজিদটিকে নামাজের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন,আর এই দরজাটি ছিল দরবার ঘরের প্রবেশ পথ।আবার কেউ কেউ বলেন,মসজিদটি মাদরাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হত।ইমাম সাহেবের বসার জায়গা হিসেবে রয়েছে মিম্বার।

চিত্রশালা
ষাট গম্বুজ মসজিদ এর অভ্যন্তরভাগ
·  খানজাহান আলির তৈরি ষাট গম্বুজ মসজিদ
· ষাট গম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গণের মূল ফটক

মসজিদের মিম্বার
মসজিদের অভ্যন্তর

হযরত খানজাহান আলি (র.) অক্টোবর ২৫,১৪৫৯ তারিখে (মাজারশরিফের শিলালিপি অনুযায়ী ৮৬৩ হিজরি ২৬শে জিলহাজ) ষাট গম্বুজ মসজিদের দরবার গৃহে এশার নামাজ রত অবস্থায় ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমার সময় খান জাহান আলির মাজারে ওরস অনুষ্ঠিত হয় এবং লক্ষাধিক লোক তাতে সমবেত হয়। বর্তমানে মোড়ল বংশ তারই সবচেয়ে নিকটবর্তী বংশধর হিসেবে খুলনা,রামপালসহ বিভিন্ন দেশ বিদেশ এ বসবাস করছে।

তথ্যসূত্র

ফিরোজ শাহী-পৃষ্ঠা ৪৭৭

No comments:

Post a Comment