বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান |
|
|
|
বাংলাদেশের ১ম রাষ্ট্রপতি
|
|
কাজের মেয়াদ
১১ এপ্রিল ১৯৭১–১২ জানুয়ারি ১৯৭২ |
|
প্রধানমন্ত্রী
|
তাজউদ্দিন
আহমেদ
|
পূর্বসূরী
|
রাষ্ট্রপতির
পদ স্থাপিত
|
উত্তরসূরী
|
সৈয়দ
নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী)
|
বাংলাদেশের ২য় প্রধানমন্ত্রী
|
|
কাজের মেয়াদ
১২ জানুয়ারি ১৯৭২ – ২৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ |
|
রাষ্ট্রপতি
|
আবু
সাঈদ চৌধুরী
মোহাম্মদউল্লাহ |
পূর্বসূরী
|
তাজউদ্দিন
আহমেদ
|
উত্তরসূরী
|
মুহাম্মদ
মনসুর আলী
|
বাংলাদেশের ৪র্থ রাষ্ট্রপতি
|
|
কাজের মেয়াদ
২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫–১৫ আগস্ট ১৯৭৫ |
|
প্রধানমন্ত্রী
|
মুহাম্মদ
মনসুর আলী
|
পূর্বসূরী
|
মোহাম্মদউল্লাহ
|
উত্তরসূরী
|
খন্দকার
মোশতাক আহমেদ
|
ব্যক্তিগত বিবরণ
|
|
জন্ম
|
১৭
মার্চ ১৯২০ টুঙ্গিপাড়া,বাংলা
প্রেসিডেন্সি,ব্রিটিশ ভারত
(বর্তমান বাংলাদেশ) |
মৃত্যু
|
১৫
আগস্ট ১৯৭৫ (বয়স ৫৫)ঢাকা,বাংলাদেশ
|
জাতীয়তা
|
বাংলাদেশি
|
রাজনৈতিক দল
|
বাংলাদেশ
কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (১৯৭৫)
|
অন্যান্য রাজনৈতিক দল
|
নিখিল
ভারত মুসলিম লীগ(১৯৪৯ সালের
পূর্বে)
আওয়ামী লীগ (১৯৪৯-১৯৭৫) |
দাম্পত্য সঙ্গী
|
বেগম
ফজিলাতুন্নেসা
|
সন্তান
|
শেখ হাসিনা
শেখ রেহানা শেখ কামাল শেখ জামাল শেখ রাসেল |
প্রাক্তন শিক্ষার্থী
|
মৌলানা
আজাদ কলেজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় |
ধর্ম
|
ইসলাম
|
শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০-১৫ আগস্ট ১৯৭৫) বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও ভারতীয় উপমহাদেশের একজন অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বাঙালীর অধিকার রক্ষায় ব্রিটিশ ভারত থেকে ভারত বিভাজন আন্দোলন এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। প্রাচীন বাঙ্গালি সভ্যতার আধুনিক স্থপতি হিসাবে শেখ মুজিবুর
রহমানকে বাংলাদেশের জাতির জনক বা জাতির পিতা বলা হয়ে থাকে। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি,বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে
এদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। জনসাধারণের কাছে তিনি শেখ মুজিব এবং
শেখ সাহেব হিসাবে বেশি পরিচিত এবং তার উপাধি বঙ্গবন্ধু।তার
কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সভানেত্রী এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ছিলেন তরুন
ছাত্রনেতা।পরবর্তীতে তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতি হন । সমাজতন্ত্রের পক্ষসমর্থনকারী একজন অধিবক্তা হিসেবে
তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি
সকল ধরণের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে
তিনি একসময় ছয় দফা স্বায়ত্ত্বশাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন যাকে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচনা করা
হয়েছিল।ছয় দফা দাবীর মধ্যে প্রধান ছিল বর্ধিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যার
কারণে তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম বিরোধী পক্ষে পরিণত হন।১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের সাথে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তার
বিচার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের
নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে।তথাপি তাকে সরকার
গঠনের সুযোগ দেয়া হয় নি।
পাকিস্তানের নতুন সরকার গঠন বিষয়ে তৎকালীন
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা বিফলে যাওয়ার পর ১৯৭১
খ্রিষ্টাব্দে মার্চ ২৫ মধ্যরাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা পরিচালনা করে।একই রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং
পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।রহিমুদ্দিন খান সামরিক আদালতে
তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে তবে তা কার্যকর করা হয় নি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত
যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামে
স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়।১০ জানুয়ারি ১৯৭২ শেখ মুজিব পাকিস্তানের কারাগার
থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি
হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। সমাজতন্ত্র ও
ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্র চালনার
চেষ্টা সত্ত্বেও তীব্র দারিদ্র্য,বেকারত্ব,সর্বব্যাপী অরাজকতা এবং সেই সাথে ব্যাপক দুর্নীতি মোকাবেলায় তিনি কঠিন
সময় অতিবাহিত করেন। ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা দমনের লক্ষ্যে ১৯৭৫
খ্রিস্টাব্দে এক দলীয় রাজনীতি ঘোষণা করেন। এর সাত মাস পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট
তারিখে একদল সামরিক কর্মকর্তার হাতে তিনি সপরিবারে নিহত হন।
প্রাথমিক জীবন
১৯৪৯ সালের ছাত্রনেতা,শেখ মুজিব
জন্ম ও শিক্ষা
শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর
রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন)
ছিলেন এবং মা'র
নাম সায়েরা খাতুন। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান।
তার বড় বোন ফাতেমা বেগম,মেজ বোন আছিয়া বেগম,সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী; তার ছোট ভাইয়ের নাম
শেখ আবু নাসের। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু
করেন যখন তার বয়স সাত বছর। নয় বছর বয়সে তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে
ভর্তি হন এবং এখানেই ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে
মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ থেকে চার বছর
তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেন নি। কারণ তার চোখে জটিল রোগের কারণে
সার্জারি করাতে হয়েছিল এবং এ থেকে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে বেশ সময় লেগেছিল।
গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।
ব্রিটিশ ভারতে
রাজনৈতিক সক্রিয়তা
মুজিবের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালে মিশনারি স্কুলে পড়ার সময়
থেকেই। এ বছর স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি র মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তিতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং এমনকি পাকিস্তানের
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। তিনি স্কুলের ছাদ সংস্কারের দাবীর উপর ভিত্তি করে একটি দল নিয়ে তাদের কাছে
যান যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে
যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪২ সনে
এনট্র্যান্স পাশ করার পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) আইন পড়ার জন্য ভর্তি হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে
সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি বেঙ্গল মুসলিম লীগে যোগ দেন
এবং অগ্রণী কাশ্মিরী বংশদ্ভুত বাঙালি মুসলিম নেতা হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর
সান্নিধ্যে আসেন।এখানে তার ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য বিষয় ছিল একটি পৃথক মুসলিম
রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন। ১৯৪৩ সনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৪ সনে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।এই সম্মেলনে শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি
কলকাতায় বসবাসকারী ফরিদপুরবাসীদের নিয়ে তৈরি "ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট
এসোসিয়েশনের" সেক্রেটারি মনোনীত হন। এর দুই বছর পর ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র
ইউনিয়নের মহাসচিব নির্বাচিত হন।১৯৪৭ সনে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর মুজিব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া
কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হওয়ার সময়ে কলকাতায়
ভয়ানক হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। এসময় মুজিব মুসলিমদের রক্ষা এবং দাঙ্গা
নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক তৎপরতায় শরিক হন।
পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালের
জানুয়ারি ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ যার মাধ্যমে
তিনি উক্ত প্রদেশের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতায় পরিণত হন।এ সময় সমাজতন্ত্রের দিকে
ঝুঁকে পড়েন এবং দারিদ্র্য,বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার নিম্নমানের উন্নয়নের জন্য এটিকেই একমাত্র সমাধান
হিসেবে মনে করতে থাকেন।
তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব
প্রাথমিক
রাজনৈতিক পদযাত্রা ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন
১৯৫০ সালে শেখ মুজিব
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনে অংশ নেয়ার
মাধ্যমেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার
সূচনা ঘটে। ১৯৪৮ সনের ফেব্রুয়ারি ২৩ তারিখে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন
গণ-পরিষদের অধিবেশনে বলেন যে,উর্দূই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তার এই মন্তব্যে সমগ্র পূর্ব
পাকিস্তনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রতিবাদী শেখ মুজিব অবিলম্বে মুসলিম
লীগের এই পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। এই
বছরের ২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের
নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে
আন্দোলনের নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করা হয় যাতে শেখ মুজিব একটি প্রস্তাব পেশ
করেছিলেন। এখান থেকেই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।এই
পরিষদের আহ্বানে ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট পালনকালে
শেখ মুজিবসহ আরও কয়েকজন রাজনৈতিক কর্মীকে সচিবালয় ভবনের সামনে থেকে গ্রেফতার করা
হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং অন্য ছাত্র
নেতাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। এদের মুক্তি উপলক্ষে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় র্যালি
হয় যাতে মুজিব সভাপতিত্ব করেন। পুলিশ এই র্যালি অবরোধ করেছিল। পুলিশী
কার্যক্রমের প্রতিবাদে শেখ মুজিব অবিলম্বে ১৭ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে দেশব্যাপী ছাত্র
ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর
কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। এতে ১১
সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে তাকে আবার আটক করা হয় এবং বহিষ্কৃত হন। উল্লেখ্য যে ২০১০
সালের ১৪ আগস্ট তাঁর হৃত ছাত্রত্ব (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ফিরিয়ে দেয়া হয়।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। জেল
থেকে বেরিয়ে তিনি আবার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে
পড়েন যার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু তিনি এই
জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা আদায় থেকে বিরত থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ এপ্রিল
মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হক টাঙ্গাইলে একটি উপ-নির্বাচনে বিজয় লাভ
করেন। শেখ মুজিব তার সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনের
ধর্মঘট করেন যার জন্য তাকে আবার আটক করা হয়। এ সময়ই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর
কর্মাচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান।
আওয়ামী লীগ
প্রতিষ্ঠা
২৩ জুন সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন। তাঁকে
দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। জুনের শেষ
দিকে জেল থেকে ছাড়া পান। ছাড়া পাওয়ার পরই খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ
দেন। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে তাঁকে সাময়িকভাবে আটক করে
রাখা হলেও অচিরেই ছাড়া পেয়ে যান। এর পর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে
মিলে লিয়াকত আলি খানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের চেষ্টা করায় ভাসানী এবং তাঁকে আটক করা হয়।
এটি ছিল অক্টোবরের শেষদিকের কথা।
১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ্য করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায়
দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে এবারও শেখ মুজিব
আটক হন। সেবার তার দুই বছর জেল হয়েছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি খাজা
নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন,উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে। এ ঘোষণার পর জেলে থাকা
সত্ত্বেও মুজিব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। জেল থেকে
নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরিচালনায় তিনি ভূমিকা
রাখেন। এরপরই ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবী আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।একই সময়ে শেখ মুজিব জেলে থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন
পালনের সিদ্ধান্ত নেন। তার এই অনশন ১৩ দিন কার্যকর ছিল।২৬ ফেব্রুয়ারি তাকে জেল
থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
যুক্তফ্রন্ট
নির্বাচন
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল
অধিবেশনের শেষে দলের সেক্রেটারী জেনারেল (মহাসচিব) নির্বাচিত হন। একই বছরের ১৪
নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালের
১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের
মধ্যে ২২৩ টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩ টি আসনই আওয়ামী লীগ
লাভ করেছিল। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। সেখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী
ছিল শক্তিশালী মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামান। ১৫ মে তাকে কৃষি ও বন
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২৯ মে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়।
৩০ মে করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর বিমান বন্দর থেকেই তাকে আটক করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর
মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন শেখ মুজিব আইন পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৭ জুন
আওয়ামী লীগ পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সম্মেলনে ২১ দফা দাবী পেশ করে যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের
স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২৩ জুন দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায়
সিদ্ধান্ত হয়,পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জিত না হলে আইন সভার সকল সদস্য
পদত্যাগ করবেন। ২৫ আগস্ট পাকিস্তানের করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশনে শেখ মুজিব বলেন:
(ইংরেজি)
« Sir [President of the Constituent Assembly],, you will see that
they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have
demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan. The
word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it
only after the people have been consulted. If you want to change it then we
have to go back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the
question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you
want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What
about joint electorate? What about Autonomy? The people of East Bengal will
be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my
friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in
the form of referendum or in the form of plebiscite.
|
(বাংলা)
স্যার [গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট], আপনি দেখবেন ওরা "পূর্ব বাংলা"
নামের পরিবর্তে "পূর্ব পাকিস্তান" নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি
জানিয়েছি যে; পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের বাংলা
[বঙ্গ] ব্যবহার করতে হবে। "বাংলা" শব্দটার একটি নিজস্ব ইতিহাস,
ঐতিহ্য আছে। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা
করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের
বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম
পরিবর্তনকে মেনে নেবে কিনা। এক ইউনিটের প্রশ্নটা গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হতে
পারে। আপনারা এটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে,
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্ননটাই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধে ভাবছেন? পূর্ব
বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা
করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাবো তারা যেন
আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ অথবা
গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন।
|
২১ অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে
দলের নাম থেকে "মুসলিম" শব্দটি বাদ দেয়া হয়। শেখ মুজিব পুনরায় দলের
মহাসচিব নির্বাচিত হন। ৩ ফেব্রয়ারি মুখ্য মন্ত্রীর সাথে আওয়ামী লীগের বৈঠকে দল
থেকে খসড়া সংবিধানে স্বায়ত্ত্বশাসন অন্তর্ভুক্ত করার দাবী জানানো হয়। ১৪ জুলাই
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব রাখা হয় যা তিনিই
সরকারের কাছে পেশ করেন। সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখ তাঁর নেতৃত্বে একটি দুর্ভিক্ষ
বিরোধী মিছিল বের হয়।১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণে এই মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে
কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়।১৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিয়ে
একযোগে শিল্প,বাণিজ্য,শ্রম,দুর্নীতিরোধ
এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।তিনি দলের জন্য সম্পূর্ণ
সময় ব্যয় করার তাগিদে ১৯৫৭ সালে ৩০ মে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।৭ আগস্ট
সরকারি সফরে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন গমন করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান দেশে সামরিক আইন জারি করে সকল ধরণের
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই বছরেরই ১১ অক্টোবর তাঁকে আটক করা হয়।
জেলে থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ভিত্তিহীন অভিযোগ আনা হয়। ১৪ মাস
একটানা আটক থাকার পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলেও জেলের ফটক থেকে পুনরায় তাঁকে
গ্রেফতার করা হয়।
পূর্ব
পাকিস্তানের প্রধান নেতা
১৯৪৯ সালে হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে শেখ মুজিব
উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করার মাধ্যমে তিনি ১৯৬১ সালে জেল থেকে
ছাড়া পান।এবার শুরু করেন গুপ্ত রাজনৈতিক তৎপরতা। অন্যান্য সাধারণ ছাত্রনেতাদের নিয়ে গোপনে স্বাধীন বাংলা
বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের
লক্ষ্যে কাজ করা। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রয়ারি জননিরাপত্তা আইনে তাকে আবার আটক করা
হয়েছিল। জুনের ২ তারিখে চার বছরব্যাপী মার্শাল ল অপসারণের পর একই মাসের ১৮ তারিখে
তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ২৫ জুন অন্য রাজনৈতিক নেতাদের সাথে মিলে আইয়ুব খান আরোপিত
বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমে পড়েন। ৫ জুন পল্টন ময়দানে
আয়োজিত এক সম্মেলনে আইয়ুব খানের সমালোচনা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর লাহোর যান এবং সেখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলে জাতীয়
গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলেন। এটি মূলত বিরোধী দলসমূহের একটি সাধারণ কাঠামো হিসেবে
কাজ করেছিল। পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলে বাংলার বিভিন্ন
স্থান সফর করেন এই যুক্তফ্রন্টের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। ১৯৬৩ সালে
সোহরাওয়ার্দীর সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে লন্ডন যান,সোহরাওয়ার্দী সেখানে চিকিৎসারত ছিলেন।এই বছরের ৫ ডিসেম্বর তিনি বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেন।
ছয় দফা আন্দোলন
সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবের বাসায় অনুষ্ঠিত
এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংহত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।এই বৈঠকের
প্রস্তাবের ভিত্তিতে শেখ মুজিব তৎকালীন
পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মহাসচিব ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১১ মার্চ
১৯৬৪ একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় যার মাধ্যমে মুজিব সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা প্রতিরোধকল্পে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেনাশাসক প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খানের
সামরিক শাসন,রাজনীতির নামে মৌলিক গণতন্ত্র প্রচলন (বেসিক ডেমোক্রেসি) এবং পাকিস্তানের
কাঠামোতে এক-ইউনিট পদ্ধতির বিরোধী নেতাদের মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন শেখ মুজিব। এই
পদ্ধতি অনুযায়ী ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার পরিকল্পনা করা হযয়েছিল এবং প্রদেশগুলোকে
একত্রে জুড়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কাজ
করতে গিয়ে মুজিব আইয়ুব-বিরোধী সর্বদলীয় প্রার্থী ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করেন।
যথারীতি নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পূর্বে তাকে আটক করা হয়। তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং
আপত্তিকর প্রস্তাব পেশের অভিযোগে অভিযুক্ত করতঃ এক বছরের কারদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অবশ্য উচ্চ আদালতের এক রায়ে তার আগেই
তিনি মুক্তি পেয়ে যান। এ সময় সামরিক বাহিনীর গণহত্যা আর বাঙালিদের চাহিদা পূরণে
সামরিক শাসকদের ঔদাসীন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত
হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী পেশ করেন যা ছিল কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের
পরিপূর্ণ রূপরেখা। শেখ মুজিব এই দাবীকে "আমাদের বাঁচার দাবী" শিরোনামে
প্রচার করেছিলেন। এই দাবীর মূল বিষয় ছিল একটি দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে
পরিচালিত পাকিস্তানী ফেডারেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এই দাবী সম্মেলনের উদ্যোক্তারা
প্রত্যাখান করেন এবং শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ কারণে
তিনি উক্ত সম্মেলন বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৬৬’র মার্চ মাসের এক তারিখে শেখ মুজিব আওয়ামী
লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের পর তিনি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন আদায়ের
লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রচার কার্য পরিচালনা করেন। প্রায় পুরো দেশই ভ্রমণ করেন। এই
ভ্রমণের সময় তিনি সিলেট,ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে
বন্দী হন। বছরের প্রথম চতুর্থাংশেই তাকে আটবার আটক করা হয়েছিল। এই বছরের মে ৮
তারিখে নারায়ণগঞ্জে পাট কারখানার শ্রমিকদের এক র্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য তাকে
আবার গ্রেফতার করা হয়। তাঁর মুক্তির দাবীতে ৭ জুন দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়।
পুলিশ এই ধর্মঘট চলাকালে গুলিবর্ষণ করে যার কারণে ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জে আনুমানিক
তিনজনের মৃত্যু হয়।
আগরতলা
ষড়যন্ত্র মামলা ও আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন
সেনাবাহিনী কর্তৃক আটক হয়ে জেলে দুই বছর থাকার পর ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে
পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার
বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছিল শেখ মুজিবসহ এই
কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের অন্তর্গত আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পূর্ব
পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে।এতে শেখ মুজিবকে এক নম্বর আসামী করা
হয় এবং পাকিস্তান বিভক্তিকরণের এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করা
হয়।অভিযুক্ত সকল আসামীকে ঢাকা সেনানিবাসে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এর অব্যবহিত পরেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী
প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এই মামলাকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে সর্বস্তরের মানুষ শেখ
মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলের মুক্তির দাবীতে রাজপথে নেমে আসে। একই বছরের ১৯ জুন ঢাকা
সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত আসামীদের বিচারকার্য
শুরু হয়।
উনসত্তরের
গণঅভ্যুত্থান
বিচারকার্য চলাকালীন সময়ে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি ৫ তারিখে কেন্দ্রীয় ছাত্র
সংগ্রাম পরিষদ তাদের এগার দফা দাবী পেশ করে যার মধ্যে শেখ মুজিবের ছয় দফার
সবগুলোই দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
প্রত্যাহারের দাবীতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম
এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়।এই গণ আন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে
পরিচিত।মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন,১৪৪ ধারা ভঙ্গ,কারফিউ,পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশ কিছু হতাহতের পর আন্দোলন চরম রূপ ধারণ
করলে পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়।তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সাথে এক গোলটেবিল বৈঠকের পর এই মামলা
প্রত্যাহার করে নেন।এর সাথে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবের
সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে(বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে শেখ
মুজিবকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধি প্রদান করা হয়। উপাধি প্রদানের ঘোষণা
দিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। এই সভায় রাখা বক্তৃতায় শেখ মুজিব ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এগার দফা দাবীর
পক্ষে তার পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত একটি সর্বদলীয় সম্মেলনে মুজিব তাঁর
ছয়-দফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চাহিদাগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান এবং তা
প্রত্যাখ্যাত হলে সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর
সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় মুজিব ঘোষণা করেন যে
এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে "বাংলাদেশ" নামে অভিহিত করা হবে:
একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে
"বাংলা" শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল।
"বাংলা" শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া
যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে 'পূর্ব
পাকিস্তানের' বদলে 'বাংলাদেশ' ডাকা হবে।
মুজিবের এই ঘোষণার ফলে সারা দেশে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানি
রাজনীতিবিদ এবং সামরিক কর্তারা তাঁকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে মূল্যায়ন
করতে শুরু করেন। মুজিবের বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ
প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে। অনেক বুদ্ধিজীবী
ব্যক্তিত্ব্যের মতে,বাঙালিদের আন্দোলন দ্বিজাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করার নামান্তর। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের
মাধ্যমেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। বাঙালিদের জাতিগত ও সংস্কৃতিগত এই
আত্মপরিচয় তাদেরকে একটি আলাদা জাতিসত্ত্বা প্রদান করে। মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক জনমত গড়ে
তুলতে সমর্থ হন এবং ১৯৭০ নাগাদ কার্যত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা
হিসেবে আবির্ভূত হন।
১৯৭০ এর
নির্বাচন ও বেসামরিক অনিয়ম
১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায়
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।পূর্ব পাকিস্তানের কোটার ২টি আসন ছাড়া
বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী
লীগ। নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ সৃষ্টি করে। পশ্চিম
পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো, মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল
বিরোধিতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে,প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি
সে সরকারকে মেনে নেবেন না। অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ও ইসলামী
রাজনৈতিক দলগুলো শেখ মুজিবের আসন্ন প্রধানমন্ত্রিত্ব লাভের বিরোধিতা করে। এসময়
শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগ কেউই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্বাধীনতার চিন্তা
করেন নি,কিছুসংখ্যক জাতীয়তাবাদী দল বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি করে।
ভুট্টো গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেখ মুজিব ও তার ঘনিষ্ঠজনদেরকে নিজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে
আলোচনায় বসার জন্য একটি গোপন বার্তা পাঠান। হাসান মুজিবের সঙ্গে গোপনে দেখা করে মুজিবকে ভুট্টোর সঙ্গে
কোয়ালিশন সরকার গঠনে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে,যেখানে ভুট্টো থাকবে রাষ্ট্রপতি এবং শেখ
মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবেন,কিন্তু বহু প্রচেষ্টার পরও তারা
শেখ মুজিবকে উক্ত প্রস্তাবে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়।একইসময়ে, ভুট্টো আসন্ন সরকার গঠনকে বানচাল করার জন্য ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ দিতে
থাকেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা
রাজনৈতিক অস্থিশীলতার মধ্যে ইয়াহিয়া খান সংসদ ডাকতে দেরি করছিলেন। বাঙালিরা
এতে বুঝে ফেলে যে,মুজিবের
দলকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন
এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন।
ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন,আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মুজিবসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য
নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ও জনসাধারণের
অসন্তোষ দমনে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে
স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। মূল ঘোষণার অনুবাদ নিম্নরূপ:
"এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা,আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের
মানুষকে আহ্বান জানাই,আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ
চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত
আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক"।
মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফয়সালাবাদের
একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হয়। পাকিস্তানি জেনারেল রহিমুদ্দিন খান মুজিবের
মামলার পরিচালনা করেন। মামলার আসল কার্যপ্রণালী এবং রায় কখনোই জনসমক্ষে প্রকাশ
করা হয় নি। এ মামলাটি "লায়ালপুর ট্রায়াল" হিসাবে অভিহিত।
১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান ও
সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অনুপস্থিতিতে
উপরাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও অস্থায়ী সশস্ত্র
বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অভিযান অল্প
সময়ের মধ্যেই হিংস্রতা ও তীব্র রক্তপাতে রূপ নেয়। রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তান
সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবি,রাজনীতিবিদ ও ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে। বাঙালি ও
অবাঙালি হিন্দুদেরকে লক্ষ্য করে বিশেষ অভিযানের কারণে সারা বছরজুড়ে প্রচুর হিন্দু
জনগোষ্ঠী সীমান্ত অতিক্রম করে পার্শ্ববর্তী পশ্চিম বঙ্গ,আসাম
ও ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ও পুলিশ রেজিমেণ্টে কর্মরত
পূর্ব বাংলার সদস্যবৃন্দ দ্রুত বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং লীগ সদস্যবৃন্দ কলকাতায়
তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব প্রবাসে বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তানে
মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্ব বড় রকমের বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক চাপ থাকা
স্বত্ত্বেও পাকিস্তানি সরকার মুজিবকে ছেড়ে দিতে এবং তাঁর সাথে সমঝোতা করতে
অস্বীকৃতি জানায়।
যুদ্ধবর্তী সময়ে মুজিবের পরিবারকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। তাঁর সন্তান শেখ
কামাল মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর এডিসি এবং একজন
গুরুত্বপূর্ণ অফিসার ছিলেন। মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর ভিতরে সংঘটিত
যুদ্ধটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সরকারের অংশগ্রহণের পর,পাকিস্তানী সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও
ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং লীগ নেতৃবৃন্দ ঢাকায় ফিরে
সরকার গঠন করেন। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক
প্রশাসক হিসাবে ক্ষমতা গ্রহণের পর জুলফিকার আলী ভুট্টো মুজিবকে ১৯৭২ সালের ৮
জানুয়ারি মুক্তি দেন। এরপর তিনি লণ্ডন হয়ে নতুন দিল্লিতে ফিরে আসেন এবং ভারতীয়
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী’র
সাথে সাক্ষাতের পর জনসমক্ষে “ভারতের জনগণ,আমার জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু” বলে তাঁকে সাধুবাদ
জানান। তিনি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি
রেসকোর্স ময়দানে এসে তিনি সেদিন প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের সামনে বক্তৃতা দেন।
বাংলাদেশের শাসন
নবরাষ্ট্র
পুনর্গঠন সংগ্রাম
শেখ মুজিবর রহমান অল্পদিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং
পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭০-এ পূর্ব পাকিস্তান
আইনসভার জন্য নির্বাচিত রাজনীতিবিদরা নতুন রাষ্ট্রের প্রথম সংসদ গঠন করেন।
মুক্তিবাহিনী এবং অন্যান্য মিলিশিয়াদের নিয়ে নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়।
তাঁরই অনুরোধক্রমে ১৭ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয় বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের
ভূ-খণ্ড ত্যাগ করে।
যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করেন। টাইম ম্যাগাজিন
ইউএসএ ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ ভাষায়
গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর
বিশ্বব্যাংকের পরিদর্শকদের একটি বিশেষ টিম কিছু শহর প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, ওগুলোকে দেখতে ভুতুড়ে নগরী মনে হয়। এরপর
থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এহেন ধ্বংসলীলার ক্ষান্তি নেই। ৬০ লাখ ঘরবাড়ি মাটির
সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ২৪ লাখ কৃষক পরিবারের কাছে জমি চাষের মতো গরু বা
উপকরণও নেই। পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে,
পুল-কালভার্টের চিহ্নও নেই এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-যোগাযোগেও অনেক
বাধাবিঘ্ন। এক মাস আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত দেশের ওপর
নির্বিচার বলাৎকার
চলেছে। যুদ্ধের শেষদিকে পাকিস্তানি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো (কার্যত প্রতিটি
ব্যবসা ক্ষেত্রই পাকিস্তানিদের দখলে ছিল) তাদের সব অর্থ-সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে
পাচার করে দেয়। যুদ্ধ শেষে চট্টগ্রামে পাকিস্তান বিমানের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১১৭
রুপি জমা পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাংক নোট ও কয়েনগুলো ধ্বংস করে
দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকার প্রকট সংকটে পড়ে। রাস্তা থেকে প্রাইভেটকারগুলো
তুলে নেওয়া হয়,গাড়ির ডিলারদের কাছে থাকা গাড়িগুলো নিয়ে নেওয়া হয় এবং এগুলো নৌবন্দর
বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে দেওয়া হয়।
বৈদেশিক নীতি
বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভের পর
শেখ মুজিব পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং ওআইসি,জাতিসংঘ ও জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনে বাংলাদেশের সদস্যপদ নিশ্চিত করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র,যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ভ্রমণ
করে বাংলাদেশের জন্য মানবীয় ও উন্নয়নকল্পের জন্য সহযোগিতা চান। তিনি ভারতের সাথে একটি ২৫ বছর মেয়াদী
মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন যাতে অর্থনৈতিক ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক
সাহায্যের আশ্বাস দেয়া হয়। চুক্তিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারি
কর্কমর্তাদের প্রশিক্ষণের শর্ত অন্তর্ভুত ছিল। মুজিব ইন্দিরা গান্ধির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন।মুজিবের
জীবদ্দশায় দুই সরকারের মধ্যে পারষ্পরিক সমঝোতা ছিল।
সংবিধান প্রনয়ন
মুজিব তাঁর অন্তর্বর্তী সংসদকে একটি নতুন সংবিধান রচনার দায়িত্ব দেন এবং
চারটি মূলনীতি হিসেবে “জাতীয়তাবাদ,
ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র”
ঘোষণা করেন যা মুজিববাদ নামেও পরিচিত।মুজিব শতাধিক পরিত্যাক্ত
শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি রাষ্ট্রীয়করণ করেন এবং ভূমি ও মূলধন বাজেয়াপ্ত করে
ভূমি পূনর্বণ্টনের মাধ্যমে কৃষকদের সাহায্যের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।মুক্তিযুদ্ধ কালে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী
প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসনের জন্য বড় পদক্ষেপ নেয়া হয়।এর ফলে
অর্থনৈতিক সঙ্কট অবসান হতে শুরু করে এবং সমূহ দুর্ভিক্ষ এড়ানো সম্ভব হয়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয় এবং ১৯৭৩
খ্রিস্টাব্দে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন
করে এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার গঠন করেন।তিনি প্রাথমিক শিক্ষা,স্বাস্থ্যব্যবস্থা,খাদ্য,স্বাস্থ্য,পানি ও বিদ্যুত সরবরাহ
নিশ্চিতকল্পে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ঘটান।১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত
বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চ বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি,গ্রামীণ
অবকাঠামো ও কুটির শিল্প উন্নয়নে প্রাগ্রাধিকারমূলক সরকারি অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ
দেয়া হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থাকা স্বত্ত্বেও মুজিব ব্যক্তিগত
ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইসলামি অনুশাসনের পথে অগ্রসর হন।তিনি পাকিস্তানি
বাহিনীর সাথে আঁতাতের অভিযোগে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামিক একাডেমি পুনরায়
চালু করেন।ইসলামিক গোত্রগুলোর জোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মদ তৈরি ও বিপণন এবং জুয়া
খেলা নিষিদ্ধ করেন।তাঁরই সিদ্ধান্তক্রমে বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কনফারেন্স ও ইসলামিক ডেভেলপমেণ্ট ব্যাংক-এর সদস্যপদ
গ্রহণ করে।মুজিব ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে
যান যা পাকিস্তানের সাথে কিছুমাত্রায় সম্পর্ক উন্নয়ন ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি
পেতে সহায়তা করে।জনসাধারণের সামনে উপস্থিতি ও ভাষণের সময় শেখ মুজিব ইসলামিক
সম্ভাষণ ও শ্লোগান ব্যবহার বাড়িয়ে দেন এবং ইসলামিক আদর্শের উল্লেখ করতে থাকেন।শেষ বছরগুলোতে মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ “জয় বাংলা” অভিবাদনের বদলে ধার্মিক
মুসলিমদের পছন্দনীয় “খোদা হাফেজ” বলতেন।
জাতীয়
রক্ষীবাহিনী
১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বাহিনী ও
ভূতপূর্ব ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সদস্যদের নিয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠন
করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ও একটি জাতীয় মিলিশিয়া বোর্ডও গঠন করা হয়,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এ বোর্ডের সদস্য ছিলেন।শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ২৪ জানুয়ারি
তারিখে এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার একটি আদেশ জারি করেন।মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর
কমান্ডার এ.এন.এম.নূরুজ্জামানকে জাতীয় মিলিশিয়ার পরিচালক নির্বাচন করা হয়।এই মিলিশিয়ার গোড়াপত্তনকালে পিলখানা গোলযোগ এর কারণে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের
সদস্যদের বাদ দিয়ে বিশেষ বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।এই অবস্থায়
১৯৭২ সালের ৮ মার্চ তারিখে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের সরকারি আদেশ জারি করা হয়।গোড়ার দিকে রক্ষীবাহিনী বেশ কিছু কার্যকর
পদক্ষেপ নিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র,চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার করে এবং মজুতদার ও কালোবাজারীদের কার্যকলাপ
কিছুটা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।কিন্তু খুব শীঘ্রই বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে
থাকে,এর কারণ রক্ষিবাহিনীর সদস্যগণ রাজনৈতিক হত্যাকান্ড,গুম,গোলাগুলি এবং ধর্ষণ সাথে জড়িত হয়ে পড়ে।তাদের যথেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণ বা তাদের কার্যকলাপের
জবাবদিহিতার আইনগত কোন ব্যবস্থা ছিল না।অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য গ্রেফতারকৃত
লোকদের প্রতি অত্যাচার,লুটপাট
এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়।১৯৭৩ সালের
১৮ অক্টোবর সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-১৯৭৩ জারি করে
রক্ষীবাহিনীর সকল কার্যকলাপ আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করে।বাহিনীটির কাঠামোগত দুর্বলতার
জন্য এবং জনগণের দৃষ্টিতে এর ভাবমূর্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকলে অনেক রক্ষী বাহিনী
ছেড়ে পালিয়ে যায়,ফলে বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য
সরকার মূল আদেশে আরেকটি সংশোধনী (জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ১৯৭৫)
জারি করে।এর মাধ্যমে বহুসংখ্যক গুরু ও লঘু অপরাধের উল্লেখ করা হয়,যার জন্য অফিসার ও রক্ষীদের বিশেষ আদালত ও সংক্ষিপ্ত আদালতে বিচার করা যাবে।
বাকশাল
স্বাধীনতা পর অচিরেই মুজিবের সরকারকে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষ সামাল দিতে
হয়।তাঁর রাষ্ট্রীয়করণ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সমাজতন্ত্রের নীতি প্রশিক্ষিত জনবল,অদক্ষতা,মাত্রাতিরিক্ত
দুর্নীতি আর দুর্বল নেতৃত্বের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।মুজিব অতিমাত্রায় জাতীয় নীতিতে
মনোনিবেশ করায় স্থানীয় সরকার প্রয়োজনীয় গুরুত্ব লাভে ব্যর্থ হয়।আওয়ামী লীগ
ও কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ করায় গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে
পড়ে।এ সময় তৃণমূল পর্যায়ে কোন নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয় নি।আওয়ামী লীগের
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে কমিউনিস্ট এবং ইসলামি মৌলবাদীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল।বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করায় ইসলামিক গোত্রের মধ্যে অসন্তোষ দেখা
দেয়।এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদে আপনজনদের নিয়োগ দেয়ার জন্য মুজিবের বিরুদ্ধে
স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়।১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ খাদ্য সংকট আরো বাড়িয়ে দেয় এবং অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষিকে ধ্বংস করে ফেলে। রাজনৈতিক
নেতৃত্বের অভাব,দ্রব্যমূল্যের অসামঞ্জস্যতা,রাষ্ট্রায়ত্ত
শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যর্থতার কারণে মুজিবকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সংঘাতের মাত্রা বাড়তে থাকায় মুজিবও তাঁর ক্ষমতা
বাড়াতে থাকেন।১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মুজিব জরুরি অবস্থা জারি করেন।
১৯৭৫ এ কয়েকটি দল মিলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামের রাজনৈতিক দল
গঠন করে যা সংক্ষেপে বাকশাল নামে পরিচিত।এই নতুন ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট সরাসরি
নির্বাচিত হবে,একটি
নির্বাচিত সংসদ আইন পাস করতে পারে।মুজিব নিজেকে আমৃত্যু রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন।
বাকশাল বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।৪টি বাদে সকল সংবাদপত্র
নিষিদ্ধ করা হয়।দলটি প্রত্যন্ত জনসাধারণ,কৃষক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের বিবেচিত করে
রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে।দলটি বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে।সরকারি বাহিনীর সাথে সমর্থকদের
নিয়ে গঠিত জাতীয় রক্ষী বাহিনীর সহায়তায় মুজিব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার
করেন এবং সারাদেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন।রক্ষী বাহিনী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে
অত্যাচার ও রাজনৈতিক হত্যার অভিযোগ ওঠে।মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারীরা মুজিবের
উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ডকে গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারবিরোধী বলে গণ্য করেন।মুজিবের বিরোধীরা অসন্তোষ ও সরকারের
ব্যর্থতার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে ওঠে।কিন্তু তার এই নীতির ফলে অবস্থা কিছুটা
নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দুর্নীতি,কালোবাজারী এবং অবৈধ মজুদদারি অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়।
হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যূষে একদল সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে রাষ্ট্রপতির
ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান,তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত
কর্মচারীদের হত্যা করে।কেবল তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম
জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান। তাদের বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যাপারে
নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য এবং সামরিক
কর্মকর্তারা।এদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ,যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে মুজিব হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে
খন্দকার মোশতাক সরকার ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন এবং জেনারেল
জিয়াউর রহমান ও পাকিস্তানপন্থী প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে তার বৈধতা দেয়া হয়।যা ১২ অগাস্ট ১৯৯৬ তারিখে সংসদে
রহিত করা হয়।সংবাদ মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের
সেণ্ট্রাল ইণ্টেলিজেন্স এজেন্সি সিআইএ-কে দায়ী করা হয়।বাংলাদেশে অবস্থিত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ইউজিন দিয়ে লরেন্স লিফসুল্জ
সিআইএ-কে সামরিক অভ্যুত্থান ও গণহত্যার জন্য দোষারোপ করেন।তাঁর মরদেহ তাঁর
জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সামরিক
তত্ত্বাবধানে দাফন করা হয়।অন্যান্যদের ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মুজিবের মৃত্যু বাংলাদেশকে বহু বছরের রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে টেনে নেয়।সেনাঅভ্যুত্থানের নেতারা অল্পদিনের মধ্যেই উচ্ছেদ হয়ে যান এবং অভ্যুত্থান,পাল্টা অভ্যুত্থান আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে
দেশ অচল হয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনীতে মারাত্মক অরাজকতা দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালের ৭ই
নভেম্বর তৃতীয় সেনা অভ্যুত্থানের ফলশ্রতিতে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা আসীন হয়।সেনাঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নেতা
কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ১৪ জন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়।বাকিরা
বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন।পরবর্তীতে ২০১০ সালে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমানসহ বাকি আসামীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে
মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
ব্যক্তীগত জীবন,পরিবার ও আত্মীয়স্বজন
১৯৩৪ সনে দাদা আব্দুল হামিদের আদেশে শেখ মুজিবের বাবা ১৪ বছর বয়সে তার সঙ্গে
তার বাবার সম্পর্কের আত্মীয় ৩ বছর বয়সের সদ্য পিতামাতাহীন ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে
দেন।বিয়ের ৯ বছর পর ১৯৪২ সালে শেখ মুজিবের ২২ বছর বয়স ও ফজিলতুন্নেসার ১২ বছর
বয়সে তারা দাম্পত্যজীবন শুরু করেন।এই দম্পতির ঘরে দুই কন্যা এবং তিন পুত্রের জন্ম
হয়।কন্যারা হলেন শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।আর পুত্রদের নাম শেখ কামাল,শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল।কামাল ১৯৭১-এ
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধের একজন সমন্বয়ক ছিলেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধকালীন কমিশন লাভ করেন।তাকে সেসময় শেখ মুজিবের
উত্তরাধিকারী হিসেবে নিবেচনা করা হত।শেখ জামাল গ্রেট ব্রিটেনের রয়েল মিলিটারি একাডেমি
স্যানডহার্স্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনড অফিসারপদে
যোগ দেন।১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বর শেখ পরিবারকে গৃহবন্দী করা হয়,শেখ কামাল ও জামাল পাহারারত সেনাদের চোখ
ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান এবং মুক্তি সংগ্রামে যোগ দেন।শেখ মুজিবের
প্রায় পুরো পরিবারই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট রাতে সেনা অভিযানে নিহত হন।শুধুমাত্র শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে ভ্রমণে থাকার কারণে বেঁচে যান। শেখ মুজিব
হলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত লেবার পার্টির রাজনীতিবিদ টিউলিপ সিদ্দিক এর নানা,যিনি ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত হ্যাম্পস্টেড
অ্যান্ড কিলবার্নের পার্লামেন্ট সদস্য।
বাংলাদেশ
বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ভাস্কর্য
বাংলাদেশী মুদ্রা ও টাকায় শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি রয়েছে এবং বাংলাদেশের বহু
সরকারি প্রতিষ্ঠান তার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
কিছু কিছু ঐতিহাসিকদের মতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতরের সংঘাত ও
বৈষম্যগুলোকে শেখ মুজিবও তাঁর দল অতিরঞ্জিত করেছিল এবং স্বাধীনতা বাংলাদেশকে শিল্প
ও মানবসম্পদের ক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখীন করে।সৌদি আরব ও চীনা সরকার শেখ মুজিবের সমালোচনা করে এবং মুজিবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অনেক দেশ
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।
অনেক ইতিহাসবিদ মুজিবকে বিদ্রোহে মদদদাতা নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং
তাঁদের মতে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্ররোচিত করলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় অদক্ষ
হিসেবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের নেতা হিসেবে শাসনকালে,মুসলিম ধর্মীয় নেতারা মুজিবের তীব্র
সমালোচনা করেন তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির কারণে। ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে ব্যাপক
সহযোগিতা গ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের সাথে একাত্মতার
কারণে অনেকে মুজিবের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। সমালোচকদের অনেকে আশঙ্কা করেন
বাংলাদেশ ভারতের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত
হবে। মুজিবের একদলের শাসন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন জনগণের একটি বড় অংশের
অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চাকে দীর্ঘসময়ের
জন্য কক্ষচ্যুত করে।
১৯৯৬ সালে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বে মুজিবের মৃত্যুর পরবর্তী
সরকারগুলোর মুজিব বিরোধিতা ও মুজিবের স্মৃতিচারণ সীমিতকরণের কারণে তাঁর সম্পর্কে
জনমনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। তাঁর ভাবমূর্তি আবার ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে
আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ফিরে আসার পর। তখন থেকে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস
হিসেবে পালন করা হয়। ২০১৬ সালে,আওয়ামী লীগ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের যে কোন সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে
সংজ্ঞায়িত করে একটি আইন পাশ করে।
শেখ মুজিবুর রহমান এখনো আওয়ামী লীগের আদর্শগত প্রতীক হয়ে আছেন এবং দলটি
মুজিবের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা ধারণ করে চলেছে। মুজিব বাংলাদেশ,ভারত ও বিশ্বের বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের কাছে
ব্যাপকভাবে সমাদৃত। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং পাকিস্তানের
গোষ্ঠীগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বাঙালিদের আন্দোলনকে স্বাধীনতার পথে ধাবিত
করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
২০০৪ সালে বিবিসি'র
বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে যে জরিপ চালানো হয়,তাতে মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন।
১৯৯৯ সালে ঢাকার আই-পি-জি-এম-আর এর নামপরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।শেখ মুজিব সড়ক নামে চট্টগ্রাম শহরের আগ্রাবাদের একটি প্রধান বাণিজ্যিক সড়কের নামকরণ করা হয়। ২০১৭ সালে ভারতের
রাজধানী নয়াদিল্লির একটি সড়কের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মার্গ নামকরণ করা হয়। কনট প্লেসের নিকটবর্তী স্থানটি ইতোপূর্বে পার্ক স্ট্রিট নামে
পরিচিত ছিল।মুজিব তার রাজনৈতিক প্রচারণায় যে কোটি পরতেন তাকে বাংলাদেশে মুজিব কোট
নামে ডাকা হয়।
বিশ্বব্যাপী
·
স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের শাসনের এক বছর পর,টাইম সাময়িকী লিখে:
মোটের উপর,বাংলাদেশের শুভ প্রথম জন্মদিন পালন করার তেমন কোন কারণ নেই।যদি এটি
একসময় হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত "খালি বাক্স" না হয়,তবে এটি মুজিবের স্বপ্ন দেখা সোনার বাংলাও হয়ে যায় নি। এতে মুজিবের ভুল
কতটুকু সেটিই এখন একটি বিতর্কের বিষয়। এটা সত্য যে,বাংলাদেশের
এই বিস্তর সমস্যাগুলোর বিরুদ্ধে লড়তে তিনি খুব অল্পই সময় পেয়েছেন। তবুও,কিছু সমালোচক দাবি করে যে,তিনি যুগান্তকারী
ব্যক্তিত্ব হিসেবে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বেশ ক্ষানিকটা সময় নষ্ট করেছেন,(যেমন তিনি ব্যক্তিগতভাবে যে কোন আমন্ত্রণে সশরীরে উপস্থিত হয়ে
সাড়া দিয়েছেন) যখন কিনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা রাষ্ট্রের প্রতি তার আরো মনোযোগী
হওয়া উচিৎ ছিল।যদি, আশানুরূপভাবে,তিনি
মার্চের নির্বাচনে জয়ী হন,তবে তিনি একটি সুস্পষ্ট পরীক্ষার
সম্মুখীন হবেন যে,তিনি কি শুধুই বাংলাদেশের জনক নাকি
পাশাপাশি এর ত্রাণকর্তাও।
·
কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো ১৯৭৩ সালের নন-এলাইনড সামিটে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বকে হিমালয় পর্বতমালার
সাথে তুলনা করেন।
·
যুক্তরাষ্ট্রের টাইম সাময়িকী ২৫ আগসট ১৯৭৫-এ তার মৃত্যুর দশ দিন পর "১৫ আগষ্ট ১৯৭৫:মুজিব,স্থপতির
মৃত্যু" শিরোনামে লিখেঃ
তাঁর প্রশংসনীয় উদ্যোগঃস্বাধীনতার পরের তিনবছরে ৬ হাজারের
ও বেশি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটে । সহিংসতা সারাদেশব্যাপি ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা তৈরী
হলে মুজিব রাষ্ট্রীয় জরুরী অবস্থা ঘোষনা করেন।চরমবাম ও চরম ডানপন্থী সংগঠনগুলো
নিষিদ্ধ করা হয়, পত্রিকাগুলোকে নিয়ে আসা হয় সরকারী নিয়ন্ত্রনে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে
অভিযান শুরু হয় ।এ উদ্যোগগুলো বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে গৃহীত হলেও অনেকেই
সমালোচনামুখর হয়ে উঠেন । সমালোচকদের উদ্দেশ্যে মুজিব তার স্বভাবসুলভ ভংগীতে
বলেনঃ-'ভুলে যেওনা আমি মাত্র তিনবছর সময় পেয়েছি । এই
সময়ের মধ্যে তোমরা কোনো দৈব পরিবর্তন আশা করতে পারোনা' ।যদি ও শেষ সময়ে তিনি নিজেই হতাশ ও বিরক্ত হয়ে কোন দৈব
পরিবর্তন ঘটানোর জন্য অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলেন ।সন্দেহাতীতভাবেই মুজিবের উদ্দেশ্য
ছিলো তার দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো । শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুজিব একটা 'সোনার বাংলা' গড়তে
চেয়েছিলেন, যে 'সোনার বাংলা'র উপমা তিনি পেয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে,ভালোবেসে মুজিব সেই 'সোনার বাংলা'র স্বপ্নকে তার দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেছিলেন।
·
২০০৩ সালে,ফ্রন্টলাইন সাময়িকীর একটি প্রবন্ধে লেখক ডেভিড
লুডেন তাকে একজন "ফরগটেন হিরো" বা বিস্মৃত বীর বলে উল্লেখ করেন।
·
বাংলাদেশী-কানাডীয় লেখক নিয়ামত ইমাম তার উপন্যাস দ্য ব্ল্যাক কোট-এ শেখ মুজিবকে নেতিবাচকরূপে দেখিয়েছেন,যেখানে মুজিবকে একজন ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসক
হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
·
২০১৭ সালের ৩০শে অক্টোবর,ইউনেস্কো শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
লিখিত গ্রন্থাবলী
·
অসমাপ্ত আত্মজীবনী,প্রকাশকাল:
২০১২।প্রকাশনী : দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।এই গ্রন্থটি ইংরেজিসহ আরো কয়েকটি ভাষায়
অনুদিত হয়।
·
কারাগারের রোজনামচা,প্রকাশকালঃ
মার্চ,২০১৭।প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমী।পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৩২।গ্রন্থটির
নামকরণ করেন শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।
তথ্যসূত্র
1.
↑ Kaushik, S. L.; Patnayak, Rama (১৯৯৫)। Modern Governments and Political Systems:
governments and politics in South Asia (ইংরেজি ভাষায়)। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 210–। আইএসবিএন 978-81-7099-592-0।
2.
Rashid,
Harun-or। "Mujib, (Bangabandhu) Sheikh Mujibur"। Banglapedia (ইংরেজি ভাষায়)। Asiatic Society of Bangladesh। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৭-০৬।
3.
Muhammad
Nurul Kadir, Independence of Bangladesh
in 266 days:
history and documentary evidence, page 440, Mukto Publishers, Dhaka,
2004, আইএসবিএন৯৮৪-৩২-০৮৫৮-৭
4.
↑ "Political Profile of Bongobondhu Sheikh Mujibur Rahman"(ইংরেজি ভাষায়)। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২০০৬-০৪-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৭-০৬।
5.
↑ "Mr. Chowdhury becomes President of
Bangladesh. - Cabinet formed by Sheikh Mujib."। Keesing's Record of World Events (ইংরেজি ভাষায়)। 18 (2): 25111। ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। (সদস্যতা নেয়া প্রয়োজন (সাহায্য))।
6.
↑ Zia, Khaleda (২০০৬-০৭-১১)। "Mujib Notes" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৭-১১।
7.
↑ M. Rashiduzzaman, The Awami League In The
Political Development of Pakistan (২০০৬-০৭-০৭)। "Awami League" (ইংরেজি ভাষায়)।সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৭-০৭।
8.
↑ G. W.
Choudhury, Bangladesh: Why It Happened (২০০৬-০৭-০৭)। "Bengali nationalism" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৭-০৭।
9.
↑ Charles
Kennedy, Craig Baxter (২০০৬-০৭-১১)। "Governance and Politics in South Asia" (ইংরেজি ভাষায়)।সংগ্রহের
তারিখ ২০০৬-০৭-১১।
10.
↑ Ahmed, Salahuddin (২০০৪)। Bangladesh: Past and Present। APH Publishing। পৃষ্ঠা 63। আইএসবিএন 978-81-7648-469-5।
11.
↑ Hassan, Mubashir (২০০০)। The Mirage of Power: An Inquiry Into the Bhutto Years। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 3। আইএসবিএন 0-19-579300-5।
12.
↑ Liton, Shakhawt (১২ জুলাই ২০১৬)। "Who was a liar - Yahya or Bhutto?"। The Daily Star। সংগ্রহের তারিখ ৩ আগস্ট ২০১৭।
13.
↑ The Mirage of Power: An Inquiry Into the Bhutto Years। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 107। আইএসবিএন 0-19-579300-5।
14.
↑ "Pakistan: Toppling Over the Brink" (ইংরেজি ভাষায়)।
Time Magazine। ১৯৭১-০৪-০৫। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১০-১৯। The army ordered a strict 24-hour curfew in Dacca,
with violators shot on sight. But soon the Free Bengal Revolutionary Radio
Center, probably somewhere in Chittagong, crackled into life. Over the
clandestine station. Mujib proclaimed the creation of the "sovereign
independent Bengali nation," and called on its people to "resist the
enemy forces at all costs in every corner of Bangla Desh." The defiant
words, however, lacked military substance. At 1:30 a.m. the following day,
soldiers seized the sheik in his home.
15.
↑ "LEADER OF REBELS IN EAST PAKISTAN REPORTED
SEIZED; Sheik Mijib Arrested After a Broadcast Proclaiming Region's
Independence DACCA CURFEW EASED Troops Said to Be Gaining in Fighting in Cities
-Heavy Losses Seen"(ইংরেজি ভাষায়)। নিউ ইয়র্ক টাইমস ২৭শে মার্চ ১৯৭১। ১৯৭১-০৩-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০৯-০১। The
Pakistan radio announced today that Sheik Mujibur Rahman, the nationalist
leader of East Pakistan, had been arrested only hours after he had proclaimed
his region independent and after open rebellion was reported in several cities
in the East.
16.
↑ Frank, Katherine (২০০২)। Indira: The Life of Indira Nehru Gandhi (ইংরেজি ভাষায়)।
USA: Houghton Mifflin। পৃষ্ঠা 336। আইএসবিএন 0-395-73097-X।
17.
↑ Frank, Katherine (২০০২)। Indira: The Life of Indira Nehru Gandhi (ইংরেজি ভাষায়)।
USA: Houghton Mifflin। পৃষ্ঠা 343। আইএসবিএন 0-395-73097-X।
18.
↑ Frank,
Katherine (২০০২)। Indira: The Life of Indira Nehru Gandhi (ইংরেজি ভাষায়)।
USA: Houghton Mifflin। পৃষ্ঠা 388। আইএসবিএন 0-395-73097-X।
19.
↑ Frank, Katherine (২০০২)। Indira: The Life of Indira Nehru Gandhi(ইংরেজি ভাষায়)। USA:
Houghton Mifflin। পৃষ্ঠা 388। আইএসবিএন 0-395-73097-X।
20.
↑ Shahzad Uddin, A Bangladeshi Soap Opera (২০০৬-০৭-০৭)। "Mujib's
policies" (PDF) (ইংরেজি ভাষায়)।
২০০৭-০৬-১৫ তারিখে মূল (PDF) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৭-০৭।
No comments:
Post a Comment